বাসস
  ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪০

অন্তর্বর্তী সরকারের একবছর : রেলের ব্যয় সংকোচনে সাশ্রয় ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা 

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): গত এক বছরে রেল চলাচলের সময়সূচিতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। বন্ধ হয়েছে টিকেট কালোবাজারী ও যাত্রী হয়রানি। 

পলাতক স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের শাসনামলে অতিরিক্ত উন্নয়ন ব্যয় ধরে তৈরি কয়েকটি প্রকল্পের ব্যয় পুনর্মুল্যায়ন ও কাঁটছাট করে রাষ্ট্রের তহবিল সাশ্রয় করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। 

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর রেলের শৃঙ্খলা ও প্রকল্প ব্যয় এভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানান রেলপথ সচিব মো ফাহিমুল ইসলাম ও রেল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন। 

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর রেল চলাচলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, টিকেট কালোবাজারি রোধ এবং স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত উন্নয়ন পরিকল্পনা পুনঃমূল্যায়ন করে ব্যয় সাশ্রয় করা হয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সুষ্ঠু রেল ব্যবস্থাপনায় গত দুটি ঈদে (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) ট্রেনের কোন শিডিউল বিপর্যয় এবং দুর্ঘটনা কিংবা ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া টিকিটের কালোবাজারি রোধ এবং শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে সকল স্টেশনে টিকিট চেকিং ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অনলাইনে টিকিট কালোবাজারি রোধে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে নেওয়া অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় হ্রাস। যথাযথ ও নির্মোহ পরিকল্পনার কারণে পদ্মা সেতু (২য় সংশোধিত) রেল সংযোগ, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেল লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন এবং আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যমুনা রেল সেতুর কাজ সম্পন্ন করে ব্রিজের ওপর ডাবল লাইন চালু করা হয়েছে। এতে ব্রিজের উপর ট্রেনের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সময় সাশ্রয় হচ্ছে। 

বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের আমলে নেওয়া কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের ফলে ৬টি প্রকল্পের বিপরীতে হ্রাসকৃত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ (২য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে প্রায় ৬২১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (২য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে প্রায় ৬ হাজার ৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেল লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর (২য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে প্রায় ৮৫৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন (রোলিং স্টক সংগ্রহ) (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে প্রায় ৩৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ (বাংলাদেশ অংশ) শীর্ষক প্রকল্পে প্রায় ১৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, খুলনা হতে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ (৩য় সংশোধিত) ১৮৩ কোটি ৩০ লাখ টাকাসহ সর্বমোট ব্যয় হ্রাস পেয়েছে ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

মন্ত্রনালয় সুত্র জানান, রেলওয়েকে আর্থিকভাবে টেকসইকরণকল্পে অপারেটিং রেশিও  হ্রাস এবং নন কোর আয় বৃদ্ধিকল্পে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রুট রেশনালাইজেশন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রেলওয়ে ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা এবং অপটিক্যাল ফাইবার লিজ প্রদান নীতিমালা হালনাগাদ করে ইজারার মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে। রেলওয়ের ব্যয় ও আয়ের অনুপাত ২.৫ থেকে ২.০৯ তে হ্রাস পেয়েছে। ব্যয় ও আয়ের অনুপাত ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রেলওয়ে অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কল সেন্টার নম্বর ১৩১ চালু করা হয়েছে। ফলে রেলসেবা সংক্রান্ত তথ্য এখন জনগণ সরাসরি জানতে পারছে।

ঢাকার আশেপাশের জেলা শহর থেকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনে ঢাকায় যাতায়াতে কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। মেট্রোরেলের কোচের আদলে ঢাকা-জয়দেবপুর-ঢাকা রুটে এক জোড়া এবং ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরব-নরসিংদী-ঢাকা রুটে এক জোড়া কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৮ জোড়া কমিউটার ট্রেন নতুন আঙ্গিকে চালু করা হয়েছে। এসব কমিউটার ট্রেনে মেট্রোরেলের কোচের ন্যায় আসন ব্যবস্থা থাকায় ট্রেনে অধিক সংখ্যক যাত্রী পরিবহন সম্ভব হচ্ছে।

রেলওয়ের জমি দখলে রাখার মতো একটি অনৈতিক সামাজিক ব্যাধি থেকে রেলকে উদ্ধার করতে অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। অবৈধ দখলকৃত রেলভূমি উদ্ধারকল্পে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে গত ৯ মাসে মোট ১৫৩টি অভিযানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৯১৮টি অবকাঠামো উচ্ছেদ করে মোট ৭৯.৪৪৪ একর রেলভূমি উদ্ধার করা হয়েছে।

রেল কর্তৃপক্ষ শূন্য পদে নিয়োগ দেয়ার কাজ শুরু করেছে। রেলওয়ের অপেক্ষমান তালিকা হতে ২০৫ জন ওয়েম্যান, ৮০ জন বুকিং সহকারী ও ২৭ জন টিকেট কালেক্টরকে শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বন্ধ স্টেশন চালু করতে ১০২ জন স্টেশন মাস্টারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় গত এক বছরে যমুনা রেল সেতু চালু, ভাঙ্গা-যশোর রুটে ৮৬ কিমি রেলপথ উদ্বোধন, খুলনা-ঢাকার মধ্যে পদ্মা সেতু হয়ে নবনির্মিত রেলপথে জাহানাবাদ এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-বেনাপোলের মধ্যে রূপসী বাংলা ট্রেন চালু করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-নরসিংদী এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বাসসকে জানান, দিনে দিনে রেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। রেল সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক একটি গণপরিবহণ। যাত্রিদের যে পরিমান টিকেটের চাহিদা বাড়ছে তাতে বুঝতে পারি যে রেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদের সময় রেলের উপর চাপ একটু বেশি থাকে। 

তিনি বলেন, ঈদের সময় প্রতিদিন ৪৭ হাজার যাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করেন। প্রতিদিন ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ৪৩টি আন্তনগর ট্রেন যাতায়াত করে। এছাড়া ৭০টি লোকাল ট্রেন যাতায়াত করে। আমাদের যে পরিমান সিট রয়েছে। যাত্রিদের চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা এতো বেশি টিকেট দিতে পারিনা। আমাদের কোচ কম। লোকোমোটিভ কম। 

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ঈদ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ট্রেনের যাত্রীদের নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে আমরা ভালোভাবে অবদান রাখতে পেরেছি। এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাত্রীরা তাদের সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেছেন। যাত্রীরা প্লাটফর্মে এসেই ট্রেন পেয়েছেন। অপেক্ষা করতে হয়নি। এটি রেলওয়ের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ছিল।

তিনি বলেন, এখানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নির্দেশনায় আমরা কর্মকর্তারা মাঠে থেকেছি। আমাদের এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা যখন রেলের দায়িত্ব নিয়েছেন তখন থেকে ব্যয় সাশ্রয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগের (আওয়ামীলীগ) সরকারের সময় যেসব বৃহৎ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলোতে ব্যয় সংকোচন করার সুযোগ ছিল। সেখান থেকে আমরা এখন পর্যন্ত আট থেকে নয় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বাসসকে বলেন, আজ থেকে ২০ বা ৩০ বছর আগে রেলওয়ের উন্নয়ন নিয়ে ততটা চিন্তাভাবনা ছিল না। বিগত সময় দেখা গেছে সড়ক পথের তুলনায় রেলপথে চলাচল অনেক নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক ছিল। সেজন্য সরকার রেলের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর সরকার গুরুত্ব না দিলে এখানে অন্য কোনো ব্যক্তির সুযোগ নেই রেলওয়ের উন্নতি করার। কারণ সরকার বাইরে (বিদেশ) থেকে রেলের জন্য ফান্ড আনে। আর আমরা সেটা বাস্তবায়ন করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থায়নের যে বিষয় সেটা তো সরকার করেন। সেই জিনিষটা আগে ছিল না। 

রেলওয়ের ভবিষ্যৎ প্রকল্প সম্পর্কে মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত একটা রেল লাইন করার জন্য একটা সমীক্ষা করা হয়েছে। তবে এই প্রকল্পের জন্য এখনো অর্থায়নের কোনো ব্যবস্থা পাইনি। এই প্রকল্পের জন্য অনেক বেশি অর্থায়নের প্রয়োজন থাকায় পর্যায়ক্রমে এটা সরকার বাস্তবায়নের চিন্তা করছে। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের জন্য পদ্মা সেতুর চেয়ে আরো বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন। সেজন্য সরকার চিন্তা করছে প্রথম ফেজে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত করা যায় কিনা। বরিশালের পর পটুয়াখালী এবং তারপর কুয়াকাটা পর্যন্ত লাইন করা।