বাসস
  ২২ জুলাই ২০২৫, ১৫:২৮
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৬:০১

ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে কান্না, প্রার্থনা আর প্রশ্ন

।। সাবীনা সুমী।।

ঢাকা, ২২ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : উত্তরার আকাশ থেকে নেমে আসা আগুনের গোলা মুহূর্তেই থামিয়ে দিলো শত শত স্বপ্নের গতি। যেসব শিশু সকালটা শুরু করেছিলো প্রতিদিনের মতো ক্লাসে যাওয়ার তাড়া আর বন্ধুত্বের হাসিতে, দুপুরের আগেই তাদের অনেকেই আর ঘরে ফেরেনি। মাইলস্টোন স্কুলের পরিচিত মাঠ, যেখানে প্রতিদিন আনন্দে দৌড়াতো শিশুরা, সেটাই পরিণত হলো মৃত্যুর বিভীষিকা মঞ্চে।

এই হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি গোটা দেশকে শোকস্তব্ধ করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমে এসেছে ভারী শোকের ছায়া। কেউ পোস্ট করেছেন হারানো বন্ধুর ছবি, কেউ লিখেছেন চোখ ভেজা স্ট্যাটাস। ‘সকালের দেখা মুখগুলো আর কোনো দিন দেখা হবে না।’ সাংবাদিক, শিক্ষক, অভিনেতা, লেখক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবার প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে শোক, হতবাক বিস্ময় আর সহানুভূতির ব্যাকুলতা।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বীরত্ব ও স্মরণ

মাইলস্টোন স্কুলের প্রাণহারানো শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীকে নিয়ে হয়েছে সবচেয়ে বেশি আলোচনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দগ্ধ অবস্থায়ও তিনি শিশুদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। একাধিক শিশুর জীবন বাঁচানোর এই বীরত্বপূর্ণ চেষ্টার জন্য নেটিজেনরা তাকে 'সাহসী শহীদ শিক্ষিকা' হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
একজন লিখেছেন, ‘কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাঁচিয়ে নিজেই চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ইতিহাস আপনাকে মনে রাখবে যুগে যুগে।’

আহত গণিত শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। অনেকেই লিখেছেন তিনি যেই ওয়ার্ডে আছেন, সেখানে সবাই তার ছাত্র। নিজের কষ্টের চেয়েও ছাত্রদের নিয়েই তিনি বেশি কাতর।

নেটিজেনরা বারবার প্রার্থনা করেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য। 

এদিকে অনেকেই ফেসবুকে কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে লিখেছেন, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো সকলেই যেন শহীদের মর্যাদা পায়।

একজন মা রিনাজ আহমেদ প্রভা লিখেছেন, ‘গতকাল রাতটা ভুলতে পারছি না। বারবার ঘুম ভেঙে বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরেছি। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার সন্তানও তো ওদের একজন হতে পারতো...’
সময় টিভির লাইভে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় এক সাংবাদিককে। আর সেই ছবি যেন প্রতীকী শোকের চিহ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে।

সূচনা নামে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক মা লিখেছেন, ইয়া রব, পোড়া দেহে যেন তারা ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো শীতলতা ও শান্তি অনুভব করে। এই যন্ত্রণা তাদের জন্য আরামদায়ক করে দিন। আমিন।’

মেয়েকে আনতে গিয়ে নিহত হলেন মা, এই সংবাদে চোখ ভিজেছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ তার পোস্টে লিখেছেন, ‘মাসুম বাচ্চাগুলোর কথা ভাবলেই নিজের হারানো সন্তানের কথা মনে পড়ে। এই কষ্ট কত অসহনীয়, আমি জানি।’
জোহরা মন্ডল সুমী নামে এক ঢাবি শিক্ষার্থী পোড়া খাতার ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আর কোনোদিন হোমওয়ার্ক করতে হবে না।’

একেএম সাদাত নামে প্রবাসী এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘একটি জুতা আমার সন্তানেরও হতে পারত। এই কষ্ট ভাষায় বোঝানো যায় না।’

শীতাংশু ভৌমিক, আরেক তরুণ গণমাধ্যমকর্মী লেখেন, ‘বীভৎস! দোয়া ছাড়া কিছু করার নেই।’

অনেকে আবার পাইলট তৌকির ইসলামকে নিয়ে আবেগঘন শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।

আবির রায়হান নামে এক ঢাবি কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘চারপাশে শুধু দুঃসংবাদ, হাহাকার আর হৃদয়চেরা কান্না।’

সাংবাদিকসহ অনেকেই জরুরি রক্ত ও তথ্য সংক্রান্ত পোস্ট দিয়েছেন।

অনেকে কালো ব্যাজের ছবি দিয়ে জাতীয় শোক প্রকাশে সংহতি জানিয়েছেন।

আতাউর রহমান নামে এক সিনিয়র সাংবাদিক লিখেছেন, ‘শোকে ভরা সোমবার।’

কান্না, প্রতিবাদ, প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া

আরিফ রেজা মাহমুদ, এক সিনিয়র সাংবাদিক। দুর্ঘটনার পরপরই তিনি লেখেন, ‘২০ বছরের সংবাদ জীবনে রোজই তো লাশ দেখি। মৃত্যুর মিছিলে লাশ গুণি। কিন্তু এবার পারছি না, ভীষণ ভারী লাগছে!’                                
এই বিষয়ে সবচেয়ে সরব ছিলেন সানাউল হক সানি নামে এক সিনিয়র সাংবাদিক। মুহূর্তে মুহূর্তে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন, যা হৃদয় স্পর্শ করেছে নেটিজেনদের।

তার প্রথম পোস্ট ছিল, ‘অবস্থা ভয়াবহ, সিজদায় পড়ো বাংলাদেশ।’

এরপর লিখেছেন, ‘সে এসেছিল যেন একটি ভোরের শিশিরবিন্দু, কাঁদার আগেই হারিয়ে গেল। কে জানে, আকাশে কোন তারার প্রয়োজন ছিল, যে কারণে পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারলো না। ঘুমাও প্রিয়, এই পৃথিবী তোমার জন্য যথেষ্ট কোমল করতে পারিনি আমরা।’

অন্য পোস্টে তিনি লেখেন, ‘চুলার আগুনের আঁচটুকুও যাতে না লাগে এমন যত্নেই বড় করা সন্তান তারা। স্কুল ছুটির পর গেটের সামনে চাতকবদনে অপেক্ষমাণ মায়েদের সন্তান এরা। আহা! সেই সন্তানই আগুনে দগ্ধ কয়লা হয়ে ফিরল! আর সেই কয়লারও আজ কেউ কেউ নানাভাবে দাম তুলছেন। কেউ কেউ গুণছেন ডলার।’

‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ন কবিতা যেন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।’ এমন পোস্টে চোখ ভিজেছে সবার।

পরক্ষণেই আবার ক্ষোভ জানিয়ে লেখেন, ‘ডাক্তার, নার্স এবং রক্তদাতা ছাড়া বাকিদের এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই! অথচ রোগী ও স্বজনদের ভিড় ঠেলে ঢুকতে হচ্ছে।’

ব্লগার দীপ্তি চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার ছেলেও মাইলস্টোনের ছাত্র। আজ যখন ওকে জড়িয়ে ধরলাম, মনে হচ্ছিল এই নিরাপত্তা অনেকের ঘরে আর নেই...’

কেউ কেউ পোস্ট করেছেন কতগুলো পোড়া স্কুলব্যাগের ছবি। 

সবুজ মুরসালিন নামে এক তরুণ কবির ভাষায়, ‘না-ফেরার দেশে চলে গেল কতগুলো প্রাণ, অথচ বয়সটা ছিল প্লেন ওড়ানোর।’

সঙ্গে ছিল একটি প্রতীকী ছবি, যেখানে ব্যাগ কাঁধে কিছু শিশু আলোকিত সিঁড়ি বেয়ে কাগজের উড়ন্ত প্লেন ধরতে এগিয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, জরুরি প্রস্তুতি ও যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। চিকিৎসক ডা. মেহেদী হাসান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যে যুদ্ধবিমান চীন ১৯৯০ সালে বাতিল করেছে, তা ২০১৩ সালে কেনো বাংলাদেশ কিনল?’

একজন সাবেক শিক্ষার্থী স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ করে লিখেছেন, ‘স্কুল ভবনের বৈধতা কি ছিল? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায় ছিল?’

প্রতীকী পোস্ট, কবিতা, ছবি ও ব্যথার আলাপন

সুমন নামে এক মফস্বল সাংবাদিক লেখেন, ‘এই মুখগুলো আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না।’

অনেকে আইডি কার্ডের ছবি শেয়ার করে খোঁজ চেয়েছেন। একজন দগ্ধ শিক্ষার্থীর ভিডিও দিয়ে লিখেছেন, তার পরিবারের খোঁজ দিতে। যদিও এ ধরনের সংবেদনশীল ভিডিও প্রকাশ সমীচীন নয়।

ফারহিন আমীন সামি নামে এক স্কুল শিক্ষিকা লিখেছেন, ‘মানুষ মরলে কার কী যায় আসে? শুধু যার যায়, সে বোঝে!’

অনেকে পোস্ট করেছেন পোড়া খাতার ছবি, ইউনিফর্মে ঢেকে যাওয়া ছোট্ট দেহ, ছেলেমেয়েদের পুরনো ছবি। এআই-প্রস্তুত এক ছবিতে দেখা গেছে, শিশুরা ব্যাগ কাঁধে তুলে অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গের আলোয় এগিয়ে যাচ্ছে।
কেউ লিখেছেন, ‘এই ইউনিফর্ম এখন পোশাক নয়, কান্নার প্রতীক।’

কন্টেন্ট ক্রিয়েটর থেকে তারকা পর্যন্ত সবাই শোক প্রকাশ করেছেন। কবিতা, প্রার্থনা, জোহরের নামাজে সিজদারত বাবার ছবি, আহতদের জন্য রক্ত সংগ্রহ, এসব মানবিক আবেগ ছুঁয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিটি দেয়াল।

শোক, প্রশ্ন এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা
সিনিয়র সাংবাদিক তামান্না মিনহাজ লিখেছেন, ‘বিমান বিধ্বস্তের খবর আসার মুহূর্তেই ছুটে যাই আমার ছেলের ঘরে। ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। বড় ছেলে মাইলস্টোনে পড়ে। এটা শুধু দুর্ঘটনা নয়, মা-বাবাদের বুকে চিরস্থায়ী শূন্যতা।’

অনেকে লিখেছেন, ‘আমরা চাই জবাব, চাই প্রতিকার; কেবল রাষ্ট্রীয় শোক নয়।’

আরেক পোস্টে উঠে এসেছে এক মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ, ‘আমার মেয়ের সব পুড়ে গেছে। কেউ কি তার ব্যথা থামাতে পারবে?’

এই বিমান দুর্ঘটনা যেন কেবল একটি সংবাদ নয়, এটি পুরো প্রজন্মের হৃদয়ে পোড়া ক্ষতের নাম।

মাইলস্টোনের মাঠে আর শোনা যাবে না শিশুদের হাসি, দৌড়, হোমওয়ার্কের অভিযোগ। এখন শুধু রয়েছে পোড়া খাতা, কাগজের প্লেন, মা-বাবার নিঃশব্দ কান্না।

এই বিমান দুর্ঘটনা যেন শুধু একটি ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি পুরো প্রজন্মের হৃদয়ে পোড়া ক্ষতের নাম। এই ক্ষণিকের ভয়াবহতায় কত মায়ের কোল খালি হলো, কত বাবার স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেলো তার হিসেব মেলানো দায়।