শিরোনাম
ঢাকা, ১১ আগস্ট ২০২৫(বাসস) : ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে উসকানি (উসকে) দিয়েছেন এবং ট্রাইব্যুনাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন উল্লেখ করে তার ৬ মাসের কারাদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
আদালত অবমাননার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৬ মাস এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতা শাকিল আলম বুলবুলকে ২ মাসের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১। দণ্ডপ্রাপ্তদের গ্রেফতার অথবা আত্মসমর্পণের দিন থেকে কারাদণ্ড কার্যকর হবে বলে গত ২ জুলাই বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা করেন। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি আজ সাংবাদিকদের দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম।
পূর্ণাঙ্গ সে রায়ে শেখ হাসিনা ও বুলবুলের (ফাঁস হওয়া অডিও) কথোপকথনটি তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে কথোপকথনের এক জায়গায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওই সব তালিকা করো আর অফিসারদের বলো আমরা তালিকা পাঠাচ্ছি নেত্রীর কাছে। উনি চাইছেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
শেখ হাসিনার এই কথার পর বুলবুল বলেন, ‘জি নেত্রী, জি আসসালামু আলাইকুম।’ এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘চাকরি সামনেও করতে হবে, এটা ভুলে যায় না যেন। এক মাঘে শীত যায় না।’
এদের দুজনের কথোপকথনের এই অংশ সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম উল্লেখ না করে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তবে ধারণা করা যায়, শেখ হাসিনা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের (প্রসিকিউটর, তদন্ত কর্মকর্তা, ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য) ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন।
এছাড়া বুলবুলের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, তিনি (শেখা হাসিনা) বলেছেন, ‘আমার তো সারা বাংলাদেশে ২২৭টি মার্ডার কেস। তোমরা তালিকা করো। ধরো অন্তত ২২৭ জনকে মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি। আর এক মামলার যে শাস্তি আর সোয়া ২০০ মামলায় সেই শাস্তি, তাই না? তো ঠিক আছে, সেই শাস্তি নেব কিন্তু তার আগে সোয়া ২০০ হিসাব করে নেব। এটা যেন মাথায় থাকে।’
পূর্নাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, বুলবুলের কাছে শেখ হাসিনা ২২৭ জনকে হত্যার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছেন। সে জন্য বুলবুলকে তিনি ২২৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করতে বলেছেন।
ফাঁস হওয়া কথোপকথনে শেখ হাসিনা বলেন ‘একটা কথা আমি বলি, তোমাদের কার বাড়ি পোড়াইছে কে?’ তখন বুলবুল বলেন, ‘ওই ওরাই নেত্রী, সবাই, জামাত-বিএনপি সকলেই।’ এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের বাড়িঘর নাই?’ বুলবুল বলেন, ‘আছে নেত্রী।’ হাসিনা বলেন, ‘তাদের ঘরবাড়ি নাই।’ বুলবুল বলেন, ‘জি, আছে।’ শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘তাহলে, সবকিছু কি প্রকাশ্যে করতে হয়?’ বুলবুল বলেন, ‘জি না, না নেত্রী, জি।’ এরপর শেখ হাসিনা, ‘আমাদের ঘরবাড়ি নাই, তাদেরও ঘরবাড়ি থাকবে না।’
কথোপকথনের এই বিষয়টি তুলে ধরে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, এসব বলে প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে বুলবুলকে উসকে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা ও বুলবুলের কথোপকথনের বিষয়টি প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা তদন্ত করেন উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, গাইবান্ধার সাংবাদিক সুমন মিয়া ফাঁস হওয়া ওই অডিও প্রথমে পান। অডিওর কথোপকথনটি স্থানীয় সাংবাদিক ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বুলবুল। তদন্তে আরও উঠে আসে, ‘এ টিম’ নামের একটি গ্রুপের (অনলাইনভিত্তিক) মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে ও জুমে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) গোপন সভা হতো। গত বছরের ২৫ অক্টোবর সে রকম একটি সভায় শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।
আদালত অবমাননার অভিযোগের এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করেন। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন শুনানি করেন শেখ হাসিনা ও শাকিল আলম বুলবুলের পক্ষে। অন্যদিকে এই মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালত বন্ধু) হিসেবে অভিমত দেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান।
জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটা মামলা হয়েছে।
শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার এখন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলে গুম-খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ একটি এবং রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে।