শিরোনাম
ঢাকা, ১৬ জুন, ২০২৫ (বাসস) : গুম ও বেআইনি গ্রেপ্তারের পেছনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে- বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্র্তী প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ কয়েকটি আইন বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিরোধী মত দমন ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা এড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
কমিশন বলেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৮ সালে। এ সময় বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। আর ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। এর জেরে মামলার সংখ্যা ফের বেড়ে যায়।
এর পর ২০২৩ সালে বিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রম রাজপথে সরাসরি সংঘাতে রূপ নেয়, আর তখন দেখা যায়, পুলিশ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়েরের প্রবণতা কিছুটা কমিয়েছে। বছরের শেষ দিকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লেও মামলার হার কম ছিল। ২০২৪ সালে নতুন মামলা দায়েরের সংখ্যা আরও কমে যায়, যা জাতীয় নির্বাচনের পর বিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রমে সামগ্রিক স্থবিরতার প্রতিফল।
প্রতিবেদন বলছে, মামলার সময়কাল এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পারস্পরিক মিল এই দাবিকে দুর্বল করে দেয় যে এসব মামলা কেবল সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার লক্ষ্যে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের ‘অস্ত্রায়িত বিচারব্যবস্থা’ অধ্যায়ে বলা হয়, আদালত ও রাষ্ট্রপক্ষ পরিচালনার প্রক্রিয়াকে এক সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক মত প্রকাশ দমন ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনসবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই আইনে অন্তত ১৯৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর রয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, ১৮৮৪ (৫১ জন) এবং অস্ত্র আইন, ১৮৭৮ (৪৩ জন)। তুলনামূলকভাবে কম মামলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এবং এর উত্তরসূরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-তে (৯ জন), ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে (৮ জন)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও ফৌজদারি আইনের মতো বিধানগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা একটি কাঠামোগত অপরাধীকরণের প্রবণতা নির্দেশ করে, যেখানে ব্যক্তিগত প্রমাণের প্রতি তেমন কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।’
ভিন্ন জেলা, বছর ও বাহিনীর অধীনে গুম বা আটক হওয়া বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে উঠে এসেছে একই ধরনের অভিজ্ঞতা, তাদের জোর করে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই অভিন্ন বিবরণগুলো থেকে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে নির্ধারিত ভাষায় স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।’
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হতো, যদি তারা ১৬৪ ধারায় নির্ধারিত বক্তব্য না দেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তা না পুনরাবৃত্তি করেন, তাহলে তাদের হত্যা, দীর্ঘমেয়াদি গুম বা পরিবারের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।
অনেকেই বলেছেন, তারা আইনজীবীর সাহায্য ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়েছেন। এতে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষাগুলো কার্যকর হয়নি, যা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারত।
গত এক দশকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যেভাবে মামলা দায়ের করেছে, তাতে সময়, স্থান ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভেদে অভিযোগপত্রগুলোর ভাষা ও ধরনে লক্ষণীয় মিল দেখা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এসব অভিযোগ ছিল অস্পষ্ট, পুনরাবৃত্তিমূলক ও একই ধাঁচে তৈরি, যা যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপনের তোয়াক্কা করে না।’
কমিশনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অভিযুক্তদের রাজনৈতিক মত, প্রতিবাদী ভূমিকা বা মতাদর্শগত অবস্থানকে একটি পূর্বনির্ধারিত জাতীয় হুমকির বয়ানে রূপান্তর করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা কিংবা কোনো আন্দোলনের প্রতি সমর্থনসূচক অনলাইন পোস্টকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে এই সমালোচনাগুলোকে চরমপন্থা, বিশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কমিশন বলেছে, ‘এই আইনি কাঠামো পূর্ববর্তী সরকারকে রাজনৈতিক বক্তব্যকে আর নাগরিক অধিকার হিসেবে না দেখে বরং তা অস্থিরতা উসকে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে।’