শিরোনাম
ঢাকা, ৩০ মে, ২০২৫ (বাসস) : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক বলেছেন, জিয়াউর রহমান দেশে উদারতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটান। রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেন। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজির বিকাশ ঘটে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। তিনি সামাজিক জীবনের নতুন এক ধারার সূচনা করেন। সব মিলিয়ে জিয়াউর রহমান দেশে মধ্যবাম ধারার সামাজিক গণতন্ত্রী কর্মসূচী শুরু করে দেশ পুর্নগঠনের কাজ শুরু করেন। তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিগুলোতে এ ধারার প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমেই রাজনীতি দিয়ে শুরু করি। জিয়াউর রহমান তৃণমূল দিয়েই রাজনীতি শুরু করেন। একদম গ্রাম থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূিচ শুরু করেন। রাজনীতির পাশাপাশি এই কর্মসূচিগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও ছিল। রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের সব থেকে বেশি অবদান হচ্ছে তিনি একটি সহিষ্ণু অবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। বহুধারায় রাজনীতিতে তিনি শান্তির সুবাতাস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন।
জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শহরের পাশাপাশি গ্রামকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে মারুফ মল্লিক বলেন, গ্রামের উন্নয়নই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুল ভিত্তি। এটাই ছিল জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম দর্শন। গ্রামের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হত। গ্রামীন জীবনের উন্নয়নের জন্য কৃষি সেচ, খাল খনন, শিক্ষা, নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সরবরাহ করা, সার, বীজ ও সেচযন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এছাড়াও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করে গ্রামীন প্রশাসন সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রাম সরকার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এরকম দুটি কর্মসূচি ছিল। গ্রামের উন্নয়নের জন্য তৃণমুল পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা। রাষ্ট্র পরিচালনাকে সরকার ও রাজনৈতিক দলের বাইরে নিয়ে যাওয়া। বিশেষ করে নারী ও যুবকদের অংশগ্রহন বাড়ানো।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরপরই দেশের যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি ছিল অগোছালো, ভঙ্গুর। যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত দেশ, এর উপর আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারের নীতি পদ্ধতি ওই সময় অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য খুব বেশি টেকসই ও উপযোগী ছিল না। কেন্দ্রীভূত, কিছুটা সমাজতান্ত্রিক স্টাইলের অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়।
মারুফ মল্লিক বলেন, সমাজতান্ত্রিক নীতি প্রয়োগের জন্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ওই সময়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের উপযোগী ছিল না। সমাজতন্ত্র ওই সময় স্লোগান হিসাবে জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন দেশে বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে। মিসরে জামাল আবদেল নাসের, লিবিয়া মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিপ্লবের কথা বলে অভ্যুত্থান করেছেন। চিলিতে সালভাদর আলেন্দকে হটিয়ে স্বৈরশাসক আউগোস্তো পিনোশেট ক্ষমতা দখল করেছেন। এর কিছুদিন আগে কিউবায় ফ্রিদেল ক্যাস্ত্রো ও চেগুয়েভেরা নেতৃত্বে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, উপনিবেশবাদের পতদের পর সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা লড়াই সংগ্রামের মত্ত। অগ্নিগর্ভ ওই সময়ে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী স্লোগান সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশও এই বিপ্লবী চেতনার বাইরে যেতে পারেনি। কিন্তু সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ক্ষমতা ওই সময়ের বাংলাদেশের ছিল না। ওই সময়ে নীতি নির্ধারকরা কিছুটা কাল্পনিক ও স্বপ্ন বিলাসি ছিলেন। আগে পিছে কিছুই বিবেচনা না করে তারা একের পর এক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন শুরু করলেন। কল কারখানা সব রাষ্ট্রীয় করণ করা হয়। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা সর্বহারা শ্রেনীর একনায়কতন্ত্র ছিল না। বরং অভিজাতদের একচেটিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছিল।
মারুফ মল্লিক বলেন, সব মিলিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিনিয়োগ বান্ধব ছিল না। সঞ্চয়ের কোনো পরিকল্পনা তৎকালীন সরকারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যত পাকিস্তান আমলের ৪র্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা ছিল। গণবান্ধব নতুন কোনো পরিকল্পনা ও নীতি ছিল না। অথচ দেশ একটি রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। অবকাঠামো ছিল পুরোপুরি বিধ্বস্ত। দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল চরমভাবে।
অব্যবস্থাপনা, বেকারত্ব, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার বেড়েছিল। বাজারে পণ্যের অভাব ছিল। খাদ্যদ্রব্যের সংকট দেখা দিয়েছিল। লবনের দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়া হয়েছিল। চোরাচালান, খাদ্যপণ্য পাচার ও অবৈধ গুদামজাত করণের কারণে পরিস্থিতি শোচনীয় আকার ধারণ করে। যে কারণে ১৯৭৪ সালে দেশ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে।
দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ব্যবস্থাপনাগত ক্রটি। পণ্যের অভাব ছিল না। দুর্ভিক্ষে সরকারি হিসাবে ২৬ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু রংপুর বিভাগেই ৮০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ মৃত্যুর শিকার হয় (অর্মত্য সেন, ১৯৮৬)। রাজনৈতিব সমস্যা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা পরিস্থিতিকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে যায়। দুর্নীতিবাজদের যথাযথ সাজা না দেওয়া ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অর্থনীতি বাজে অবস্থায় চলে যায় (অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান)।
মারুফ মল্লিক বলেন, এই অবস্থায় জিয়াউর রহমানের উপর প্রবল চাপ ছিল দেশের অর্থনীতিকে পুর্নগঠন করার এবং একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা। তার সামনে দুটি বিকল্প ছিল। ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রবর্তন করা সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখা। অথবা পশ্চিম ইউরোপের মডেল অনুসরণ করে মধ্য বাম ধারার সামাজিক গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা।
তিনি দ্বিতীয় পথেই হাটলেন। দেশের রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিলেন। অর্থনীতিকে উদার করলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন না। এ জন্য তিনি একটি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মুক্ত বাজার নীতির প্রয়োগ করেন। এতে তিনি সফল হয়েছিলেন। দেশের মানুষও দ্রুত সুফল ভোগ করেছিল। সহসাই পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে।
বাজারে পণ্যের সরবরাহও বৃদ্ধি পায়।
তিনি বলেন,জিয়াউর রহমান প্রথম যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে সারাদেশকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা। তিনিও আশা করতেন সবাই নিয়ামানুবর্তি হবে এবং দেশের জন্য সর্বোচ্চ শ্রমদান করবে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রভুত উন্নতি সাধিত হয়। কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন মিল কারখানা ও টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। জিয়াউর রহমানের নীতিতে সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম বন্টনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। অর্থনীতিতে তিনি মেধা অনুসারে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূল লক্ষ্য ছিল উৎপাদনমুখী অর্থনীতি, রপ্তানী বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
মারুফ মল্লিক বলেন, জিয়াউর রহমানের রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না তা হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন নীতি। জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গীর বদ্বীপের চরিত্র বিবেচনা করে উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরিবেশ, প্রকৃতির ক্ষতি না করে বরং অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে ওই সময় খাল খননের কথা উল্লেখ করা যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে সারাদেশে ২৬ হাজার মাইল খাল খনন করা হয়েছিল। এই খালগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রভাব ছিল গভীর ও সুদুর প্রসারী। প্রথমমত এই খালগুলো ছিল স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে, পরিবেশের ক্ষতি না করে পানি ব্যবস্থাপনার চমৎকার উদাহরণ। আমাদের এখানে উজান থেকে পানি আসে। আর দক্ষিণে রয়েছে লবনাক্ততা। খালগুলো পানি প্রবাহের জায়গা বিস্তৃত করেছিল। শুষ্ক মওসুমে জলাধার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘অথচ এখন আমরা ডেল্টা প্ল্যান করে পানি সংরক্ষণাগার তৈরির কথা বলি। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালেই স্বল্প খরচে করে দেখিয়েছেন কিভাবে সারাদেশে প্রাকৃতিক জলাধার তৈরি করা সম্ভব। কৃষিতে খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল। যে কারণে খাল খনন জাতীয় কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিল।
এর পাশাপাশি জিয়াউর রহমান সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশের প্রতিটি মহাসড়ক, সড়ক ও মেঠো পথের দুই পাশে ফল গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পক্ষে পুষ্টিকর ফল খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। নেহায়েত অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে তিনি গাছ লাগানোর কথা বলেননি। পাশাপাশি এর সামাজিক সুবিধার কথাও বিবেচনা করেছিলেন। মূলত জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনার ভিত্তি ছিল, মাটি, পানি, প্রকৃতি ও পরিবেশের যথাসম্ভব ক্ষতি না করে উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন,অর্থনীতির চাকাকে সচল করার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব মধ্যবাম ধারার টেকসই উদার উন্নয়ন নীতি জিয়াউর রহমানকে বাস্তবিক অর্থেই মাঠের মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে নেতারা থাকতেন মঞ্চে ও রাজপথে। এই প্রথম একজন শাসক মাঠে, খালে, বিলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। একসঙ্গে খাল কাটলেন। পাশাপাশি বসে আহার করলেন। এটাই মূলত জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।