বাসস
  ২৯ মে ২০২৫, ১৮:২০

অভিভাবকদের অসচেতনতায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বাড়ছে

 আব্বাছ হোসেন

লক্ষ্মীপুর, ২৯ মে, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু । প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও পানিতে ডুবে শিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বসতবাড়ির আশপাশে থাকা পুকুর, ডোবা, নালাতে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা। অভিভাবকদের অসচেতনতা ও শিশুদের সাঁতার না জানার কারণেই এমন মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। 

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জেলার পাঁচ উপজেলায় পানিতে ডুবে ১১১ জন শিশুর মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মে মাসে আরও চারজন শিশু পানিতে পড়ে মারা যাওয়ার তথ্য রয়েছে। পানিতে পড়া যে সব শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, ওইসব শিশুর মৃত্যুর সংখ্যাই কেবল রেকর্ড করা হয়। যেসব শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের  অনেককেই হাসপাতালে আনা হয় না। ফলে পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে।  

হাসপাতালের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে জেলা সদর হাসপাতালে ৩৫ জন, রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন, কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৭ জন, রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন এবং রামগঞ্জে ২৪ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে।  

চিকিৎসকরা বলেন, পানিতে পড়া বেশিরভাগ শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই মারা যায়। পাঁচ মিনিটের মতো পানিতে ডুবে থাকলেই শিশুর মৃত্যু হয়। মৃত অবস্থায়ই বেশির ভাগ শিশুকে হাসপাতালে আনা হয়। 
সম্প্রতি জেলার কয়েকটি পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৫ মে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩নং বাঞ্চানগর এলাকায় মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি বেড়াতে এসে বাড়ির উঠোনে খেলা করতে করতেই বাড়ির পাশের পুকুরে পড়ে যায় শিশু নাজিম হোসেন ও জিহাদ হোসেন। কিছুক্ষণ পরেই পরিবারের লোক তাদের মরদেহ পুকুরের পানিতে ভাসতে দেখে। সম্পর্কে তারা খালাতো ভাই ছিল। বয়স আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে। 

১৪ মে বিকেলে জেলার কমলনগরের চর লরেন্স ইউনিয়নের উত্তর চর লরেন্স গ্রামে আল-আমিন নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। গত ১৭ মে জেলার রায়পুরের বামনী ইউনিয়নের বাঁশতলি নামক স্থানে সিমি নামে দুই বছর বয়সী এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারের লোকজনের ব্যস্ততার সময় তারা শিশুদের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়লে  এসব দুর্ঘটনা ঘটে। শিশুরা বাড়ির উঠোনে খেলা করার সময় পরিবারের লোকজনের অগোচরে বাড়ির পাশে থাকা পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। জীবন শুরুর আগেই তাদের জীবন প্রদীপ নিভে যায়।  

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অরূপ পাল  বাসসকে বলেন, বসতবাড়ির আশপাশে অরক্ষিতভাবে ডোবা বা পুকুর থাকার কারণে শিশুরা খুব সহজেই পানিতে পড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এবং ডোবা বা পুকুর চারপাশে ঘের দিয়ে দিলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। 

একই দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে দুই বা তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ ঘটছে। ২০২৪ সালের ১১ মে রামগতি উপজেলার চর বাদাম এলাকায় একটি গর্তে পড়ে ডুবে গিয়ে দুই ভাই-বোনের মৃত্যু হয়। নিহত শিশুরা হলো, তাহিয়া আক্তার (৫) ও তার ভাই মো. আবদুল্লাহ (৩)। ঘরের পাশে পাকা ভবন নির্মাণে পিলারের জন্য খোঁড়া গর্তে জমে থাকা পানিতে পড়ে এমন নির্মম ঘটনার শিকার হয় তারা। একজন পড়ে যাওয়ার পর আরেকজন তাকে বাঁচাতে গিয়ে দুইজনেরই প্রাণ যায়।

২০১৮ সালের ১৭ আগস্ট সদর উপজেলার দালাল বাজার মহাদেবপুর এলাকায় পুকুর পাড়ে খেলতে গিয়ে তিন শিশু পানিতে পড়ে মারা যায়। নিহত শিশুরা হলো বায়েজিদ (৭),  মো. আলী (৬) ও  ইয়ামিন (৭)। এদের মধ্যে দুইজন একই পরিবারের সদস্য। স্বজনদের ধারণা, একটি শিশু পড়ে যাওয়ার পর তাকে বাঁচাতে গিয়ে পর পর আরও দুই শিশু পানিতে নেমে পড়ে।  

চাইল্ড অ্যান্ড উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এর নির্বাহী পরিচালক পারভীন হালিম বাসসকে বলেন,  পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে শিশুদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের আরও মনোযোগী হতে হবে। প্রতিটি শিশুকে সাঁতার শেখাতে হবে । 

তিনি বলেন, পানিতে পড়ে ঠিক কত সংখ্যক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব নেই। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেব থেকেও সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি হবে। উপকূলীয় এ জেলাতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বর্ষায় বৃষ্টিপাতের কারণে বসতবাড়ির আশপাশে থাকা ডোবা বা নালা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। এছাড়া পুকুর তো রয়েছেই। এগুলো অরক্ষিত থাকায় শিশুরা খুব সহজেই পানিতে নেমে যেতে পারে। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। 

তিনি জানান, সাধারণত এক বছর বয়স থেকে শুরু করে ৭-৮ বছর বয়সী শিশুরা পানিতে পড়ে মারা যায়। যে সব শিশু একেবারে ছোট, তাদের দিকে পরিবারের সদস্যদের সর্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে হবে। আর সাঁতার শেখার উপযোগী শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে। এটা খেলাধুলার একটি অংশ হতে পারে। তিনি প্রতিটি জেলায় সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য পুকুর বা সুইমিংপুলের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।  

জানা যায়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে সরকার ২০২২ সালে সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেয়। বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের অধীনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি সংস্থা 'পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র' শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে সুবিধাভোগী শিশু ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে।

লক্ষ্মীপুর শিশু অ্যাকাডেমির আইসিডিসি প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, পানিতে ডুবে প্রচুর শিশু মারা যাচ্ছে। বেশিরভাগ পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় সাঁতার না জানার কারণে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার কমাতে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন আমরা মনিটরিং করবো।

এ প্রকল্পের আওতায় ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবে। বৃষ্টিতে পুকুরের পানি বৃদ্ধি পেলে জুনের পর থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে। এ জেলার চার হাজার শিশু প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে।

তিন ধাপে শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিশুরা যাতে কমপক্ষে একনাগাড়ে ২৫ মিনিট সাঁতার কাটতে পারে। কারো সাহায্য ছাড়াই কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড যাতে পানিতে ভেসে থাকতে পারে এবং একটি শিশু যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং অন্যকে সহায়তা করতে পারে।