শিরোনাম
কুমিল্লা (দক্ষিণ), ২৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো/তবু আমারে দেবো না ভুলিতে...। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই চয়নটুকু চিরভাস্বর হয়ে আছে কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে। আগামীকাল রোববার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী।
‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানঃ কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’। এ প্রতিপাদ্য নিয়ে কবির স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লায় এবার জাতীয় পর্যায়ে নানা আয়োজনে পালিত হবে তিনদিন ব্যাপী ১২৬ তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। সম্পন্ন হয়েছে সকল প্রস্তুতি। এ নিয়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে কুমিল্লায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে কুমিল্লা। কুমিল্লায় বিচরণের মধ্য দিয়ে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী কবি। কবির প্রেম, বিয়ে, সুরকার-গায়ক, অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠার অনেক কিছুর প্রথম এই কুমিল্লা। দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১১ মাস কুমিল্লায় অবস্থান করেছেন। এই দীর্ঘ অবস্থান ঘিরে নজরুলের জীবনের মোড় ঘুরার প্রেক্ষাপট এই কুমিল্লাতেই সৃষ্টি হয়েছিল।
শহরের কান্দিরপাড়র ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ি, ধর্মসাগর পাড়, রাণীর দীঘির পাড়, মহেশাঙ্গন, দারোগাবাড়ি, টাউনহল ময়দান, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মনের চর্থার রাজবাড়ি, নবাব বাড়িসহ কুমিল্লার আনাচে-কানাচে এবং মুরাদনগরের দৌলতপুরে তার সদর্প পদচারনার অসংখ্য স্মৃতি কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে জেগে আছে। ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ নেতা প্রিন্স অব ওয়েলস এর কলকাতায় আগমন উপলক্ষ্যে ভারতীয় কংগ্রেস হরতাল ডাকে। ওই হরতালে কবি নজরুল গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গানে মিছিল করেন। এ অপরাধে রাজগঞ্জ থেকে তাকে আটক করা হয়। এই ঘটনাই কবির বিদ্রোহী কবিতার প্রেক্ষাপটের অনেক অনুসঙ্গেও একটি বলে মনে করেন গবেষকরা।
এছাড়া কবির জীবনে কুমিল্লার মুরাদনগরের খাঁ বাড়ির নার্গিস আর এই শহরের পশ্চিম কান্দিরপাড়ের আশালতা সেন গুপ্তা ওরফে প্রমীলা নামের দুই নারী এসেছিলেন জীবনসঙ্গিনী হয়ে। নার্গিস ও প্রমীলা কবির জীবনে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এ সময়ে তিনি কুমিল্লায় বসে অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন।
কুমিল্লায় কবি নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। এসব স্মৃতি জাগরুক করে রাখার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রী শাখায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ছাত্রাবাস। ১৯৬২ সালে কান্দিরপাড় থেকে ফরিদা বিদ্যায়তন পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় নজরুল সাহিত্য চর্চার লক্ষ্যে গঠিত হয় নজরুল ললিতকলা পরিষদ। যা পরবর্তীতে নজরুল পরিষদ নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৩ সালে কুমিল্লা শহরের যেসব স্থানে নজরুল বিচরণ ও অবস্থান করেছিলেন সেসব স্থানে টিনের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ১৯৯২ সালে ওইসব স্থানে কবি নজরুলের অবস্থান ও ঘটে যাওয়া ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে পাকা স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে নির্মিত হয় ‘চেতনায় নজরুল’ স্মৃতিস্তম্ভ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা ও চর্চার করতে প্রতিষ্ঠিত হয় কবি নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লা। এ ছাড়া মুরাদনগরের দৌলতপুরে খা বাড়ির কিছু স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়।
ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল জানান, কুমিল্লায় তিনদিনব্যাপী নজরুল জন্মবার্ষিকীর জাতীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে এতে আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা অত্যান্ত আনন্দিত। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে, ২য় দিন জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে কবির প্রথম স্ত্রী নার্গিস আসার খানমের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হবে। কবির জীবনের উল্লেখযোগ্য স্থান মুরাদনগরের দৌলতপুর। সুদীর্ঘ ১০২ বছর পর মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এই প্রথম বারের মতো ঐতিহ্য কুমিল্লা প্রকাশিত ‘দৌলতপুরে নজরুল’ শীর্ষক একটি গ্রন্থের মোড়ক উম্নোচন করা হবে ২য় দিন।
আবৃত্তি শিল্পী ও নজরুল গবেষক কাজী মাহতাব সুমন বলেন, আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কবির জন্ম হলেও নজরুলের প্রেম, বিয়ে, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চাসহ বহু ঘটনার নিরব সাক্ষী কুমিল্লা। তিনি অমর হয়ে আছেন কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে।
বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বেশি। কুমিল্লা ও দৌলতপুরে কবি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করেছেন। তাই নজরুল চর্চা ও গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠছে স্থানীয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এবার নজরুল জন্মবার্ষিকীর জাতীয় অনুষ্ঠান কুমিল্লায় হওয়াই খুশি জেলাবাসী।
কবি নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, কবির স্মৃতি স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষন করতে আমাদের মন্ত্রনালয়সহ আমরা চেষ্টা করছি। কবি নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্য কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র। এখানে রয়েছে নজরুল জাদুঘর ও পাঠাগার।
জানা যায়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ মে, কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে তিনদিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান।
২৫ মে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিকেল ৩টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং কবি পৌত্রী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান খিলখিল কাজী। স্মারক বক্তৃতা করবেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এবং স্বাগত বক্তৃতা করবেন- কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার।
২৬ মে দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠান হবে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে এবং ২৭ মে সমাপনী অনুষ্ঠান কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।