বাসস
  ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩১

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একবছর: মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে নানামুখী কাজের উদ্যোগ

কাশেম মাহমুদ

ঢাকা, ৮ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছরে শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের পুর্নবাসন, তাদের চিকিৎসা, জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি রক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে। এই কঠিন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ৯০হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের উদ্যোগও নিতে হয়েছে মন্ত্রণালয়কে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে এক কঠিন সময় পার করে আসতে হয়েছে। একদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের নির্ভুল তালিকা তৈরি, অপরদিকে হাসপাতালে মৃত্যু দূতের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা হাজার হাজার আহতদের কাতরানো জুলাই যোদ্ধাদের সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। শহীদ এবং আহতদের পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক শক্তি জোগানো। সেসব পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে স্বাবলম্বী করানোর প্রচেষ্টা। এর পাশাপাশি দেশের সকল রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক, পেশাজীবীসহ আপামর জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজ করতে হয়েছে। সেই দায়িত্ব পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওপর।

গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন।

দেশের গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিকদলগুলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে। এই আয়োজনের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে। গণভবনকে জুলাই স্মৃতি যাদুঘরে রূপান্তর করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট সেই স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন।  

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র (বাসস) বিশেষ সংবাদদাতা’র সাথে আলাপকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক উক্ত মন্ত্রণালয়ের কাজের নানা দিক তুলে ধরেন।  

তিনি জানান, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আরেকদফা বিজয় অর্জন করেছে এদেশের মানুষ। ফ্যাসিস্ট, একদলীয় শাসনের পৃষ্ঠপোষক ও শোষক আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের দোসরদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে ছাত্র জনতার বিপ্লব। এই গণঅভ্যুত্থানই দেশকে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই বিপ্লবের চেতনায় আবার গড়ে তোলার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে এদেশের গণতন্ত্র প্রিয় ছাত্রজনতা ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। যেই আকাঙ্ক্ষার কথা এখন দেশের জনগণ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে মাঠের বক্তৃতা বিবৃতিতে অভিহিত করতে চান।

উপদেষ্টা বলেন, ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বারুদ বিদ্রোহে জ্বলে উঠা ছাত্র জনতার প্রতিবাদ ও  গর্জে উঠার প্রতিধ্বনি।বৈষম্যের বিরুদ্ধে এদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণের বুক ফাটা কান্নার আওয়াজ। বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়া সাহসী যুবকের দেশপ্রেম। মা-বোন, নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ বনিতা রাজপথে গর্জে উঠেছিল দেশের মানুষের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দাবিতে। স্লোগান ছিল বৈষম্যের  বিরুদ্ধে। জুলাই বিপ্লব ও গণ আন্দোলনের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার সেসব তরুণ-তরুণী, যুবসমাজ, ছাত্র জনতার প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওপর জুলাইয়ের চেতনা শানিত করে মানুষের প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব পড়েছে। গত এক বছরে সেই কাজ কতটুকু করতে পেরেছে তার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান বর্ণনা করেছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

উপদেষ্টা আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বছরের কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্য এখানে দেওয়া কঠিন। কারণ মন্ত্রণালয়ের কাজের মূল্যায়ন সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বা নির্দিষ্ট প্রকল্পের ভিত্তিতে করা হয়। তবে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজগুলো হলো: মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া। মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের দায়িত্ব। গঠিত হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর। গত ৩০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন ‘ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামে অভিহিত। এই অধিদপ্তর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা ও তথ্য সংরক্ষণ, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের সরকার নির্ধারিত এককালীন ও মাসিক সহায়তা প্রদান এবং শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ের কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। সময় কম, কাজ বেশী। আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আবেদন পেয়ে হতাশ হয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাচাই বাছাই করার। এখানেও আদালতে রুজু করা মামলা। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কমে আসার কথা ছিল। সেখানে কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েছে। 

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জুলাই যোদ্ধা এবং জুলাই শহীদ পরিবারের কল্যাণ ও পুনর্বাসনের জন্য গৃহীত কার্যক্রম হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮৪৪ জনের গেজেট প্রকাশ করা হলেও অভিযোগ ও দ্বৈততার কারণে ৮ জনের গেজেট বাতিল করা হয়। ফলে বর্তমানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ জন। আহতদের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী জুলাই যোদ্ধাগণের  মধ্যে আহতের ধরণ অনুযায়ী ১৩ হাজার ৮০০ জন জুলাই যোদ্ধার গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ক শ্রেণি-৬০২ জন, খ শ্রেণি- এক হাজার ১১৮ জন, গ শ্রেণি- ১২ হাজার ৮০ জন। 

জুলাই যোদ্ধাদের সার্বিক  কল্যাণ দেখভালের জন্য ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠার গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের ১৭ জুন তারিখে 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার ও আহত ছাত্র-জনতার কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫' জারি করা হয়।

উপদেষ্টা জানান, জুলাই আহতদের বৈদেশিক চিকিৎসায় মোট ব্যয় হয়েছে ৯৭ কোটি ৫০ লক্ষ ২৮ হাজার ১০২ টাকা। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১১ জন, রাশিয়ায় ১ জন, থাইল্যান্ডে ৫৯ জন, তুরস্ক ৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই শহীদ পরিবারের কল্যাণের জন্য এককালীন অনুদান হিসেবে প্রথম পর্বে (২৪-২৫ অর্থবছরে) প্রত্যেককে ১০ লক্ষ টাকা ৭৭২ টি পরিবারকে মোট ৭৭ কোটি ২০ লক্ষ টাকার সঞ্চয় পত্র প্রদান করা হয়েছে। দ্বিতীয়  পর্বে চলতি অর্থবছরে (২৫-২৬) ২০ লক্ষ টাকা করে ৯৭জন শহিদ পরিবারকে, ৩০ লক্ষ টাকা করে ৩ জন শহিদ পরিবার অর্থাৎ ১০০ পরিবারকে মোট ২০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ৪৫০ পরিবারকে ভাতা প্রদান করা হয়েছে মোট ৯০ লক্ষ টাকা।

তিনি বলেন, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে 'ক' ক্যাটাগরির ৪৯৩ জন জুলাই যোদ্ধার প্রত্যেককে মোট ২ লক্ষ টাকা করে ৯ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা এবং ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে ২৫ জনকে ৩ লক্ষ টাকা করে ২ কোটি ৪৩ লাখসহ সর্বমোট ১২ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। ‘খ' ক্যাটাগরির ৯০৮ জন জুলাই যোদ্ধার প্রত্যেককে  ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক লাখ টাকা করে মোট ৯ কোটি ৮ লক্ষ টাকা এবং ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে ১৪০ জন জুলাই যোদ্ধাকে ২ লক্ষ টাকা করে ২ কোটি ৮০ লক্ষসহ সর্বমোট ১১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে। 'গ' ক্যাটাগরির ১০ হাজার ৬৪২ জন জুলাই যোদ্ধার প্রত্যেককে মোট ১ লক্ষ টাকা করে মোট ১০৬ কোটি ৪২ লক্ষ টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ‘ক’ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধাদের ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। গত জুলাই মাসে ২১৫ জনকে ৪৩ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। খ শ্রেণির জুলাই যোদ্ধাকে ১৫ হাজার টাকা করে জুলাই মাসে ৪৩৩ জনকে দেয়া হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। গ শ্রেণির জন্যে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে ৬০৩৩ জনকে জুলাই মাসে ৬ কোটি ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। 

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর বাইরে প্রথমবারের মতো জুলাই গণঅভ্যুখান দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপনের জন্য সকল জেলায় সর্বমোট ৩ কোটি ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। সকল শ্রেণীর জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সকল সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহে সকল শ্রেণীর আহত জুলাই যোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, ২০২৪-২০২৫ এবং ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে এ পর্যন্ত আহত জুলাই যোদ্ধাদের বিদেশে চিকিৎসা, শহীদ পরিবারের অনুকূলে পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং আহতদের অনুকূলে এককালীন অনুদান, শহিদ ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা, গণঅভ্যুত্থান দিবস উদ্‌যাপন বাবদ সর্বমোট টাকা ৩৩৬ কোটি ৬৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ১০২ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

উপদেষ্টা বলেন, দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন সুবিধা, মাসিক ভাতাসহ এলাকায় প্রভাব খাটাতেই বিভিন্ন পন্থায় বাগিয়ে নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ। বিগত সরকারের ১৫ বছরে নতুন নতুন তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। এসব ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ও উৎসব ভাতায় সরকারের খরচ হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

তিনি জানান, ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা জীবিত মুক্তিযোদ্ধা আছেন, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তাদের সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার।

তাদের কল্যাণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা, নীতি ও কার্যক্রম  প্রণয়ন ও দেখাশুনা করার জন্য স্বাধীনতা অর্জনের ৩০ বছর পর ২০০১ সালে ২৩ অক্টোবর আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়’ গঠন করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। অথচ দেখা যাচ্ছে, গত ৩০ বছরে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার নতুন মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হয়ে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জনে। ২০২৪ সালে ৩০ বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমার কথা ছিল।

কারণ, এই সময়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু বরণ করেছেন। কিন্তু হিসেবের খাতায় হয়েছে উলটো। গত ৩০ বছরে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার নতুন মুক্তিযোদ্ধা যুক্ত হয়েছেন। এরা ভুয়া নাকি আসল সেটিই এখন বিবেচ্য বিষয় মন্ত্রণালয়ের। এরমধ্যে সরকারি চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন ৮৯ হাজার ২৩৫ জন।
উপদেষ্টা জানান, ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আবেদন যাচাই বাছাই করে একটি ডাটাবেজ তৈরির চেষ্টা করেও আইনি বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার যাচাই-বাছাইয়ের নোটিশ পেয়ে অনেকেই আদালতে মামলা করে দিচ্ছেন। 

তিনি বলেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২ ‘সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন’ এবং আইনের (২০২২ সনের ১৫ নং আইনের ধারা- ২,৫,৬,৯,১১,১৩,১৪,১৫,১৬,২১,২৫) সংশোধন করা হয়েছে। অতঃপর উক্ত আইন বলিয়া উল্লিখিত, এর প্রস্তাবনায় উল্লিখিত “জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করিবার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করিবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের” শব্দগুলির পরিবর্তে “জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী পরিবারের” শব্দগুলি ও কমাগুলি প্রতিস্থাপিত হইবে।

উক্ত আইনের ধারা ৫ এর উপ-ধারা (১) এর- (ক) দফা (ক) এ তিনবার উল্লিখিত “মন্ত্রী” শব্দটির পরিবর্তে “মন্ত্রী বা উপদেষ্টা” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হইবে; এবং (খ) দফা (গ) এ উল্লিখিত-(অ) “বীর মুক্তিযোদ্ধা,” শব্দগুলি ও কমার পর “মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী,” শব্দগুলি ও কমা সন্নিবেশিত হইবে; এবং (আ) “মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের” শব্দগুলির পরিবর্তে “মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী পরিবারের” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হইবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আমরা এর ব্যাখ্যা দিয়েছি। মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং দুই মন্ত্রী মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ মুজিবনগর সরকারে যারা ছিলেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা সশস্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যারা পরিচালনা করেছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা। তবে ওই সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। ২০১৮ ও ২০২২ সালের মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার যে বিকৃতি করা হয়েছে, তার সংশোধন করে ১৯৭২ সালের তৎকালীন সরকারের নির্ধারিত সংজ্ঞায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ কূটনীতিকরা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা। সহযোগী মানে এই নয় যে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। সরাসরি যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে মুজিবনগর সরকার, বীরাঙ্গনা এবং মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসকদের সহায়কদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে গত ৩ জুন জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে জারি করা হয়। গত ১৫ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

নতুন অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বলতে ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধকে’ বোঝানো হয়েছে। অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার ছাড়াও চার শ্রেণির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক সরকার প্রতিবছরই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বাড়িয়েছে। ফলে তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমান অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের উদ্যোগ নিলে দেশের ৬৪ জেলা থেকে ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আবেদন জমা পড়ে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এর মতে এ সংখ্যা লক্ষাধিক। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

জামুকার তথ্যমতে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। প্রথম ধাপে কুমিল্লার ৩১ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার শুনানি হয়েছে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে। শুনানিতে মাঠ প্রশাসন, অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও অভিযোগ ওঠা ব্যক্তি, স্ত্রী-সন্তানকে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহ ও তথ্যপ্রমাণসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছে। পরবর্তীকালে অন্যান্য অভিযোগগুলো যাচাই বাছাইয়ের শুনানি করা হবে।

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক। দায়িত্ব নেওয়ার পর এক সপ্তাহের মাথায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন তিনি। তার নির্দেশনার পর দেশের জেলা, উপজেলা থেকে মন্ত্রণালয়ে এবং জামুকায় হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল পুনর্গঠন করা হয়েছে। কাউন্সিল মনে করে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সম্মান রক্ষায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত হওয়া উচিত। সেজন্য প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে সে সময়কার সাক্ষ্যপ্রমাণ, তথ্যপ্রমাণ নিখুঁতভাবে নিরূপণের চেষ্টা করা হবে।

জামুকা সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত দেশে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তের সংখ্যা ৮৯ হাজার ২৩৫ জন। গেজেট বাতিল, মুক্তিযোদ্ধার বয়সসীমা নির্ধারণসহ প্রায় ১৪ ক্যাটাগরিতে মোট মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৭১৯টি। ইতোমধ্যে নির্ধারিত বয়সের (১২ বছর ৬ মাস) কম হওয়ায় ২ হাজার ১১১ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে। এ নিয়ে বিগত ১৫ বছরে ৩ হাজার ৯২৬ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল হলো।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে প্রায় যে ৯০ হাজারকে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে তাদের পেছনে সরকারের বাৎসরিক খরচ ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বর্তমানে একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পান। এ ছাড়া ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ১০ হাজার করে, স্বাধীনতা দিবসে ৫ হাজার এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়।