শিরোনাম
এসকে রাসেল
কিশোরগঞ্জ, ১০ মে ২০২৫ (বাসস): কয়েক দিন পরই গ্রামজুড়ে চলবে লিচু ভাঙার মহোৎসব। রসাল, সুমিষ্ট, সুন্দর গন্ধ ও গাঢ় গোলাপি রঙের কারণে এ লিচুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার লিচুর ফলনও হয়েছে প্রচুর। লিচু বিক্রি করেই ১০ কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে বলে আশা করছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ। এ গ্রামের লিচু রফতানি হচ্ছে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়া। প্রায় দুইশ বছর আগে সুদূর চীন থেকে কোনো এক ব্যক্তি প্রথমে একটি চারা গাছ এনে লাগায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার পৌর এলাকা মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। অধিক ফলন ও রসে টসটসে ছোট বিচির কারণে এ লিচু এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিছু দিনের মধ্যেই এ জাতের লিচুর কলম চারা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে। অধিক ফলন ও লাভজনক দাম পাওয়ায় দ্রুতই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। বর্তমানে এলাকার বাড়িতে বাড়িতে শোভা পাচ্ছে এ লিচুর গাছ। এ গ্রামের নামেই লিচুর নাম রাখা হয়েছে ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’।
স্থানীয় বাজারে অনেক জাতের লিচু উঠলেও ক্রেতাদের চোখ এখন রসে টসটসে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর দিকে। এ লিচুর স্বাদ নেওয়ার জন্য মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ভিড় করেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার লিচুপ্রেমী ক্রেতারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাছে থাকতেই এ লিচু বিক্রি হয় চড়া দামে। প্রতি একশ লিচু বর্তমানে বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। মঙ্গলবাড়িয়ার অধিকাংশ লিচু বাগানই আগাম বিক্রি হয়ে যায়। কিছু পাইকার অগ্রিম গাছ কিনে অতিরিক্ত দামে লিচু বিক্রি করে থাকেন। এবারও ভালো দাম পাবেন বলে চাষি ও পাইকার সবার মুখে হাসি।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, লিচু বাগানগুলোতে উপসহকারী কৃষি অফিসার নিয়মিত গিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাছাড়াও এবছর এ গ্রামের লিচু চাষিদের নিয়ে লিচু সমিতি করা হয়েছে। এই লিচু সমিতির উদ্যোগে কিভাবে ফলন ভালো করা যায় সে বিষয়ে চাষিদের নিয়ে কর্মশালাও করা হয়েছে।
পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবার লিচু চাষের সাথে জড়িত। এছাড়াও এই জাতের লিচু আশপাশের গ্রাম কুমারপু, নারান্দী ও হোসেন্দীতে বিস্তার লাভ করেছে। এ বছর বাগানগুলো থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা।
লিচু চাষি সফির উদ্দিন জানান, তার বাবা দীর্ঘ দিন লিচু চাষের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি নিজে লিচু চাষ করেন। তার ৫০-৬০টি লিচু গাছ রয়েছে। লিচু চাষ করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। প্রতি বছর লিচু থেকে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করেন। এর পাশাপাশি তার রয়েছে মৌ খামার ও লিচুর চারা উৎপাদনের ব্যবসা।
লিচু চাষি কবীর হোসেন বাসসকে বলেন, ‘এ গ্রামটি লিচু গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই কম বেশি লিচু গাছ আছে। কীভাবে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে এ ব্যাপারে কৃষি অফিসের মাধ্যমে সবাইকে সহায়তা ও পরামর্শ দেয়া হয়। কোন সময় কি ঔষধ দিতে হবে তাও উপসহকারী কৃিষ অফিসার আমাদের পরামর্শ দেন। এবার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। আশা করছি আমরা সবাই লাভবান হবো।’
স্থানীয় লিচু ব্যবসায়ী তৌহিদ মিয়া বলেন, আমি ১০৫টি গাছ ২ লাখ টাকায় কিনেছি। ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখানে কমপক্ষে আমি ৫ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবো। কারণ এ লিচু নিয়ে বাজারে যাওয়া লাগবে না। গাছ তলাতেই সব লিচু বিক্রি হয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ লিচু কিনতে এ গ্রামে আসবেন।
এই গ্রামে লিচু কিনতে আসা আশিকুজ্জামান আশিক বাসসকে বলেন, আমি প্রতি বছরই লিচু কিনতে মঙ্গলবাড়িয়া আসি। লিচু কিনে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পাঠাই। এ লিচু খেতে অনেক সুস্বাদু । তবে গত কয়েক বছর ধরে এখানে একটি সিন্ডিকেট লিচুর দাম বৃদ্ধ করে সাধারণ ক্রেতাদের হয়রানি করে আসছিলো। শুনেছি এবার চাষিরা একশ লিচুর দাম ৬০০ টাকা করে দিয়েছে। এখানে প্রশাসনের নজর দেয়া উচিত।
লিচু ক্রেতা সোনিয়া আক্তার বলেন, লোকমুখে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর অনেক প্রশংসা শুনেছি। তাই এবার লিচু কিনতে মঙ্গলবাড়িয়ায় এসেছি। প্রশংসা যেমন শুনেছি আসলে তেমনই রসে টসটসে সুস্বাদু এ লিচু।
নরসিংদী থেকে মঙ্গলবাড়িয়ায় লিচু কিনতে আসা চাকুরিজীবী জাকারিয়া হোসেন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মঙ্গলবাড়িয়ার সুস্বাদু লিচুর খবর পেয়ে লিচু কিনতে নরসিংদী থেকে এসেছি। লিচু বাগানে বসে অনেক লিচু খেয়েছি। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের জন্যও লিচু কিনে নিয়েছি।
স্থানীয় লিচুর ব্যাপারী মো. মামুন মিয়া বলেন, ৫ বছর প্রবাসে ছিলাম, ছুটিতে বাড়িতে এসেই লিচু ব্যবসা শুরু করে দিয়েছি। আমার মতো স্থানীয় অনেক যুবকই এই মৌসুমে লিচু ব্যবসা করে লাভবান হয়। ব্যবসায়ীরা কিছু গাছ অগ্রিম কিনে নেয়। আবার কিছু গাছ লিচু পাকার সময়ে কেনে।
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচু সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান হেলাল জানান, আমাদের পরিবারে ৪৫টি লিচু গাছ রয়েছে। এই মৌসুমে লিচু বিক্রি করে আমরা বাড়তি আয় করে থাকি। গ্রামে প্রতি বছরই নতুন নতুন বাগান হচ্ছে। অনেকে জমির চারপাশের আইলে লিচু গাছ রোপণ করে বাগান তৈরি করছে। এ বছর কৃষি অফিস থেকে আমাদের গ্রামের লিচু চাষিদের নিয়ে লিচু সমিতি করে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর ফরিয়া ব্যবসায়ীরা এখানে এসে সিন্ডিকেট করে লিচুর দাম বৃদ্ধি করে গ্রামের সুনাম নষ্ট করেছে। এবার আমরা কৃষি অফিসারের সাথে পরামর্শ করে গ্রামের চাষিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কেউ যাতে অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি করে সিন্ডিকেট না করতে পারে। সমিতির মাধ্যমে কৃষি অফিসের সহায়তায় লিচু চাষের উপর কর্মশালা হয়েছে। এতে করে চাষিরা উপকৃত হয়েছে।
পাকুন্দিয়া পৌরসভার উপসহকারী কৃষি অফিসার মাইদুল হক জানান, এবার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচু চাষিদের নিয়ে লিচু সমিতি করা হয়েছে। এই সমিতির মাধ্যমে কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে লিচু চাষ সম্পর্কে কর্মশালা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ব্লকে এই মৌসুমে আরো তিনজন উপসহকারী কৃষি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাতে কৃষকরা উপকৃত হন।
পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার নূর-ই-আলম জানান, মঙ্গলবাড়িয়ার মাটি লিচু চাষের জন্য উপযোগী। এ গ্রামের উৎপাদিত লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু। প্রতিটি লিচুই গোলাপি রঙের। শাঁস মোটা, রসে ভরপুর, গন্ধও অতুলনীয়। মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবার লিচু চাষের সাথে জড়িত। এছাড়াও আশপাশের গ্রাম কুমারপুর, নারান্দী ও হোসেন্দীতেও এখন লিচু চাষ হচ্ছে। এ বছর বাগানগুলো থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে চাষিদের যাবতীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।