শিরোনাম
তানভীর হায়াত খান
নেত্রকোনা, ১০ মার্চ ২০২৫ (বাসস): হাওর-বাওর, পাহাড়-সমতলের ধর্ম-বর্ণ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উর্বর ভূমি নেত্রকোনা জেলা। ইতিহাস, ঐতিহ্যে ভরপুর এ জেলায় রয়েছে বহু শতাব্দীর পুরনো মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন। মুঘল স্থাপত্যের এমনই এক নিদর্শন নেত্রকোনার ‘হারুলিয়া মসজিদ’।
জেলার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফ্ফরপুর ইউনিয়নের হারুলিয়া গ্রামে অবস্থিত এই হারুলিয়া মসজিদ এক গম্বুজের ছোট একটি মসজিদ। তবে এই মসজিদের সঠিক ইতিহাস এখনও অজানা স্থানীয়দের কাছে। এই মসজিদটি গাইনের মসজিদ নামেও পরিচিতি।
মাত্র ৭ শতাংশ ভূমির ওপর নির্মিত মসজিদটির চার কোনায় চারটি পিলার রয়েছে, যার উপরিভাগ কলসি দিয়ে গম্বুজাকার কারুকার্যমণ্ডিত। চৌকোন বিশিষ্ট মসজিদটির ছাদজুড়ে একটি মাত্র বিশালাকার গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তিনটি লম্বাটে দরগা এবং সামনের অংশে ছোট একটি চৌচালা টিনের ঘর। ধারণা করা হয়, জায়গা কম থাকায় মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে এই চৌচালা নির্মিত হয়েছে। নির্মাণশৈলী ও অবকাঠামো দেখে ধারণা করা হয়, পোড়ামাটি, লালি, চুন, চিনি, চিটাগুড়, কস এবং এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে এই প্রাচীন মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
এমন ছোট চার মিনারের মসজিটি কি কারনে কোন সময় করা হয়েছিলো এর কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও স্থানীয়দের দাবী এটি ১২০০ খ্রীস্টাব্দে তৈরী। তবে গবেষকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, এই মসজিদটি কোনভাবেই ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের নয়। বরং এটি ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের পরে নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, এই মসজিদে একটি পাথর ছিলো যা দুই বছর আগে চুরি হয়ে যায়। সেটিতে আরবিতে একটি সন লিখা ছিলো। তারা হিজরি ওই সনটি হিসেবে করে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ বের করেন। মসজিদের ইমাম মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, এই মসজিদের পুরাতন ইমাম ঐ পাথরটি দেখেছেন। তিনি বলেছেন, চুরি হওয়া পাথরটির ভেতরে আরবি ফারসি ভাষায় লেখা অনুযায়ী ১২০০ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ আছে। তবে এই মসজিদটি নিয়ে আজো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন উদ্যোগ বা গবেষণা না থাকায় সঠিক ইতিহাস এখনো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, মুঘল শাসন আমলে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর অত্যন্ত স্নেহভাজন ও অনুসারী শাইখ মোহাম্মদ ইয়ার নামক এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ১২০০ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটির দেয়ালে ফার্সিতে শাইখ মোহাম্মদ ইয়ারের নাম ও ১২০০ খ্রিস্টাব্দ লেখা থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা।
আলী আহম্মদ খান আইয়োব তাঁর "নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস "গ্রন্থে লিখেছেন, "রোয়াইলবাড়ি থেকে ৮/৯ কিলোমিটার দূরে পরিখা বেষ্টিত জাফরপুর গ্রামের ধ্বংস প্রাপ্ত মসজিদের ইটের নক্সা ও কারুকাজ রোয়াইলবাড়ি মসজিদের ইট ও কারুকাজ একই রকম। এতে মনে হয় এ দু'টি মসজিদ একই সময়ে স্থাপিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক একেএম খাদেমুল হক বাসসকে বলেন, " ছবিতে যে ভবনটি দেখা যাচ্ছে, সেটি দৃশ্যত মুঘল আমলের টেকনোলজিতে তৈরি। মুঘল আমলে এই রকম এক গম্বুজ বিশিষ্ট অত্যন্ত ছোট পরিসরের অনেক মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
তিনি বলেন, প্রকাশিত সংবাদে যে শিলালিপির কথা বলা হয়েছে, সেটার কোনো ছবিও যদি পাওয়া যেত, তাহলে ভালো হতো। জানার চেষ্টা করা যেত, সালটা খ্রিস্টাব্দ ১২০০ না ১২০০ হিজরি (১৭৮৫/৮৬ খ্রি.) ঠিক এই সময়েই পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম অনেক ছোট ছোট মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।’
তিনি আরো বলেন, শিলালিপির ভাষা ফারসি হওয়াটাও মুঘল আমলের কথাই নির্দেশ করে; সতেরো শতকে মুঘলরা আসার আগের সব শিলালিপির ভাষা আরবি ছিলো।
এলাকাবাসীর ধারণা অনুযায়ী, মুঘল আমলে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর শাসনকালে এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে। উপমহাদেশে তৎকালীন সময় নির্মিতব্য আটটি মসজিদের মধ্যে এটি একটি। গ্রামবাসী এটিকে হারুলিয়া দক্ষিণপাড়া পুরাতন জামে মসজিদ বলে চেনে। তবে অযত্ন আর অবহেলায় ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে চলেছে বহু বছরের পুরনো মুসলিম স্থাপত্যের এই নিদর্শন।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দুই বছর আগে রাতের আঁধারে কে বা কারা মসজিদের ভেতরে ঢুকে ফার্সিতে লেখাযুক্ত একটি বহু মূল্যবান ছয়-সাত কেজি ওজনের কষ্টি পাথর চুরি করে নিয়ে যায়। কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিলেন, কিন্তু সেই পাথর আজও উদ্ধার করা যায়নি। মসজিদটির সামনে রয়েছে বিশালাকার জালিয়ার হাওর।
বর্তমানে নান্দনিক ছোট এই মসজিদকে বাড়িয়ে স্থানীয়রা একটি পাকা মসজিদ করেছেন। এদিকে পাথর চুরির পরেই তারা বুঝতে পেরেছেন যে এই মসজিদের কোন ইতিহাস বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিলো পাথরে। অথবা অনেক দামী ছিলো পাথরটি।
তবে কেউ কেউ বলছেন, এ এলাকায় হাওর বাওর নদী থাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন নৌকায় বাণিজ্য করতে আসতেন। তখনকার সময়ে এই গ্রামে কোন মানুষ ছিলো না। জঙ্গলাকীর্ণ ও হাওরবেষ্টিত হওয়ায় হয়তো নামাজ বা বিশ্রামের জন্য কোন সওদাগর এটি বানিয়ে থাকতে পারেন। আবার বসতি স্থাপনের জন্য গ্রামটিতে এই স্থাপনা করেছিলেন বলে জানান স্থানীয় গবেষক হুমায়ূন কবীর। তিনি বলেন, এ এলাকার পুর্বপুরষদের মধ্যে তেমন নামাজের প্রচলন ছিলো না বলে জানা গেছে। এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের জন্যও কেউ এটি স্থাপন করে থাকতে পারেন।
স্থানীয় মুসল্লি লতিফ মিয়া জানান, মুঘল আমলে নির্মিত এ সুপ্রাচীন মসজিদটি ইসলামি ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তারা নানা পুঁথি পড়ে জেনেছেন মুঘলদের রাজত্বকালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির অত্যন্ত স্নেহধন্য শাইখ মুহাম্মদ ইয়ার নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ১২০০ খ্রিস্টাব্দে এ এলাকায় আসার পর মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মুহাম্মদ মুনতাছির মোহাইমেন বাসসকে বলেন, " মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে এটাকে কোন ভাবেই সুলতানী আমলের প্রাথমিক সময়ের মসজিদ মনে হচ্ছেনা, বরং মুঘল আমলের মসজিদই বেশি মনে হচ্ছে। তাছাড়া ১২০০ সালে এইটি নির্মিত হয়েছে সেই তথ্যটি অসত্য। এটি ১৭০০ সালের পরে নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।"
নেত্রকোনা জেলার তথা দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে তার জৌলুস হারিয়ে ক্রমশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দ্রুততম সময়ে সংস্কার না করতে পারলে হারিয়ে যেতে পারে মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ।