শিরোনাম
ঢাকা, ১১ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাস ছয়জনকে হত্যার এই মামলার সাক্ষী হয়ে আসামিদের ফাঁসি চাইলেন।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে ছেলে হারা এই পিতা আজ বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট মাকে একটি চিঠি লিখে সকালে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিল আনাস। চিঠিতে আনাস লিখেছিল ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইও।’
সেই চিঠিটি তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করেছেন এবং তা এই মামলার জব্দতালিকায় বস্তু প্রদর্শনী হিসেবে আছে উল্লেখ করে আনাসের বাবা বলেন, ‘এই চিঠির মাধ্যমে বুঝতে পারি আনাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে গিয়েছে। এরপর ওইদিন দুপুর দেড়টার দিকে আনাসের মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন ধরতেই জানতে চাওয়া হয় আমাদের কেউ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে গিয়েছে কিনা। আমার স্ত্রী বলেন, আমার ছেলে আনাস গিয়েছে। ওই লোকটি তখন দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলেন। এই সংবাদ শুনে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই।’
আনাসের বাবা তার সাক্ষ্যে বলেন, মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে আনাসের ভর্তির কাগজ, সিমছাড়া মোবাইল ফোন ও মৃত্যু সনদসহ আনাসকে নিয়ে রিকশায় করে বাসায় ফেরেন তারা। ফেরার পর এলাকার লোকজন আনাসের লাশ নিয়ে মিছিল করে। মিছিল থেকে আনাসের মৃত্যুর জন্য শেখ হাসিনার ফাঁসি চাওয়া হয়। ওইদিনই আসরের নামাজের পর আনাসের মৃতদেহ গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে নেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে গিয়ে দেখি শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (১৪) নামের আরেক ছাত্রের লাশও জানাজার জন্য আনা হয়েছে। সে-ও ওইদিন চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুজনের জানাজা একসঙ্গে হয়। আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। তাকে শহীদী মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পোশাকেই দাফন করা হয়।’
আনাসের সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারী রাব্বী হোসেন ও সৌরভ আহম্মেদের বরাত দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকার পরিস্থিতির বর্ণনা দেন সাক্ষী সাহরিয়ার খান (পলাশ)। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টার বর্ণনায় আনাসের বাবা সাক্ষী পলাশ বলেন, ‘তারা (আনাস, রাব্বি ও সৌরভসহ আন্দোলনকারীরা) চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। চানখারপুল এলাকায় তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র জনতা জড়ো হয়। পুলিশ নিরন্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, শর্টগান এবং চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। নিমতলীর নবাব কাটারা গলির ভেতর আনাসকে টার্গেট করে গুলি করে পুলিশ। একটা গুলি আমার ছেলের বুকের বামপাশে বিদ্ধ হয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি করা লোকটি এপিবিএনের পোশাক পরা ছিল।
আনাস গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে রাব্বি হোসেন, সৌরভ আহম্মেদসহ আরো কয়েকজন রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাব্বিসহ আরো অনেকেই ঘটনাটির ভিডিও করে। পরে ভিডিওগুলি আমাকে দেওয়া হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে তা জব্দ করেছেন।’ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার জন্য সাক্ষী সাহরিয়ার খান (পলাশ) আসামিদের দায়ী করে তাদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
আনাসের বাবার এই সাক্ষ্য গ্রহণের পর আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাক্ষীকে জেরা করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। ইমাজ হোসেনের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী জিয়াউর রশিদ টিটো, আসামি সুজন হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী আবুল হোসেন। আর পলাতক আসামিদের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবুদ্দিন। মঙ্গলবার এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্র্যাইব্যুনাল।
জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের আগে আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও মামলার আদ্যোপান্ত তুলে ধরে বলেন, ‘এই বিচার কার্যক্রম পুরোনো রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এটি প্রমাণ করে যে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদেরও আইনসম্মত জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণ বিশ্বাস করতে পারবে যে ন্যায়বিচার কোনো অবস্থাতেই পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রভাবিত নয়। বরং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, দৃঢ় এবং নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে।’
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘যদিও এই মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান অভিযুক্ত, তবুও এই বিচার প্রক্রিয়া তারসহ সাত আসামির জন্য সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। বিচার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যাতে সমস্ত পক্ষের আইনি অধিকার নিশ্চিত হয়। এ ধরনের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা দেশের আইনি সংস্কৃতির প্রতি জনগণের আস্থাকে আরও দৃঢ় করবে এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবে।’
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন। সেই সঙ্গে এই মামলার সূচনা বক্তব্যের ও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়।
এই মামলায় যে আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তারা হলে- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। এই আসামির মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। অন্য চারজন গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার চারজনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।