বাসস
  ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৯:১৬

শেখ হাসিনার পতনের দিন মিছিলে মুখরিত ছিল চট্টগ্রাম

ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরের আগেই শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে অনেকেই এটি গুজব মনে করেন। কিন্তু দুপুরে টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে ওঠে, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। 

তখন লোকজন মোটামুটি নিশ্চিত হয়, বড় কিছু ঘটে গেছে। দুপুর আড়াইটার দিকে খবর আসে পদত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন। তখনই মুহূর্তের মধ্যে মুক্তির প্রতীক্ষায় উন্মুখ চট্টগ্রামের লাখো জনতা নেমে আসে রাস্তায়। মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয় পুরো বন্দরনগরী। একপর্যায়ে নগরীর সড়কগুলো দখলে নেয় ছাত্র-জনতা।

আগেরদিন ৪ আগস্ট সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও শিক্ষার্থী থেকে দিনমজুর, পেশাজীবী থেকে সমাজকর্মী- সবাই রাজপথে নেমে আসে একযোগে। পুরো নগরীই চলে যায় কার্যত ছাত্র-জনতার দখলে। কিন্তু চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এদিন ছাত্র-জনতার ওপর দলীয় সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে নিহত হয় শতাধিক মানুষ। চারিদিকে আগুন, লাশ, কান্না আর ক্ষোভ।

সেদিন চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুপুরের পর জনতার স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো শহর। মোড়ে মোড়ে চলে মিষ্টি বিতরণ। ফুল বিনিময় করেন অনেকে। বিজয় মিছিলে প্রিয়জনের সঙ্গে ছবি তুলে স্মৃতি সংরক্ষণ করেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিন ধরে হাসিনার নিপীড়নের শিকার হওয়া লোকজনের কাছে ওইদিন ছিল উৎসবের মতোই আনন্দের।

শহরের নানা পেশা ও বয়সের মানুষ ওই সময় সড়কে নেমে নিজেদের দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে আনন্দ-উল্লাস করেন। তারা বুঝতে পারেন, অবশেষে দেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। দীর্ঘদিন পর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে মুক্তির স্বাদ নিয়ে মিছিল করতে থাকেন। মাদরাসা থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখো সাধারণ জনতা। নগরীর কাজির দেউড়ি, আসকারদিঘী, জামালখান, আন্দরকিল্লা, লালদিঘী থেকে নিউমার্কেট, আবার চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, জিইসি মোড়, ওয়াসা, টাইগারপাস হয়ে আগ্রাবাদ, বন্দর, সল্টগোলা, ইপিজেড, কাটগড়, পতেঙ্গা- সবখানেই শুধু মানুষ আর মানুষ।

কিছু জায়গায় পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকলেও বিকেলের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ঘিরে ফেলে ছাত্র-জনতা। কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং ও লোহাগড়াসহ বিভিন্ন থানায় আক্রমণ শুরু হয় বিক্ষুব্ধ জনতার। এসব থানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুলিশের অস্ত্র ও গুলি নিয়ে যায় অনেকে। এসময় অনেক পুলিশ সদস্য কোনো রকমে থানা থেকে পালিয়ে যায়। কেউ কেউ পোশাক পরিবর্তন করে জনতার সঙ্গে মিশে যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রামজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাসায় হামলা ও কোনো কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

নগরীর লালদিঘীর পাড়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নিউমার্কেট এলাকায় দোস্ত বিল্ডিংয়ে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দারুল ফজল মার্কেটে নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। নগরীর বহদ্দারহাটে সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। নগরীর পাথরঘাটায় সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিমের বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

এছাড়া নগরীজুড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় সব ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়। শেখ হাসিনার ছবি ও নামফলক ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। তবে হামলা থেকে রক্ষায় নগরী ও জেলায় বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে পাহারা বসায় বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘এক বছর আগের এই দিনে ১৫ বছরের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল। মনে হয়েছিল আমরা দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা শ্বাস ফিরে পাচ্ছি। তবে আশা করেছিলাম হাসিনা পালানোর পর এ দেশটা নতুনভাবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে থাকা পক্ষগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। সংস্কার প্রক্রিয়াও ভালোভাবে এগোয়নি। তারপরও আশায় আছি, জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী চেতনায় এ দেশ সামনে এগিয়ে যাবে।’

চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিন বিকেলে খবর শুনে আমার মনে হচ্ছিল, আমরা মুক্ত। কখনো আর ভয় পেতে হবে না। রাজনৈতিক কারণে আমার মতো অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেননি। সেদিন লোকজন রাস্তায় নেমেছিল, যেন সব বাঁধন খুলে গিয়েছিল।’

ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল বলেন, ‘সেদিন আমরা ঘর থেকে বের হয়েছি শহীদ হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে। সকাল থেকেই সবাইকে নিয়ে সড়কে অবস্থান নিই। কেউ উত্তর পাহাড়তলী, কেউ অলংকার মোড়, কেউ কাজির দেউড়িতে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম চূড়ান্ত ঘোষণা পাওয়ার জন্য। দুপুর ১টার পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছে আমরা কারো মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পাইনি, সবাই চিৎকার করে কাঁদছিলাম।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘এক দফা দাবিতে সকাল থেকে আন্দোলনে ছিলাম। দুপুরে খবর পাই হাসিনা পালিয়েছে। কী আনন্দ, আশপাশের কেউ কেউ আনন্দে কান্না করেছেন। কেউ কেউ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন মুক্তিকামী জনতা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে পড়েছিল।’ 

এ ঘটনাকে স্মরণ করে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।