শিরোনাম
ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন
নাটোর, ৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : নতুনের কেতন উড়িয়ে জয়ধ্বনি করতে করতে লাখো মানুষের রাস্তায় নেমে আসার দিন আজ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সফলতা প্রাপ্তির দিন আজ। বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণের দিন আজ। চব্বিশের ৫ আগস্ট বাঁধভাঙা জোয়ারের মত নাটোরের রাজপথে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। কিন্তু এই বিজয় মিছিলের পরিণতি ছিল বিষাদময়, হৃদয়বিদারক। এদিন ধ্বংসস্তূপের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান পাঁচজন। তাদের নাম আজ শহীদের তালিকায়।
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরে নাটোরের মানুষ আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন। দুপুরের পর থেকেই তারা রাস্তায় নেমে আসেন। বিকেল চারটায় শহরের স্বাধীনতা চত্বর থেকে বের হয় বিজয় শোভাযাত্রা। অনেকের হাতে জাতীয় পতাকা। অনেকের মাথায় জাতীয় পতাকার রঙে মাথায় কাপড়ের ব্যান্ড। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, কন্যারা, মায়েরাসহ সব ধরনের মানুষের ঠিকানা ছিল যেন রাজপথ। স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু বৈচিত্র্যময় এ শোভাযাত্রা।
বিজয় মিছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাড়ি অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ফুঁসে উঠা জনস্রোতের তাণ্ডবে শিমুলের বাড়ি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে, দেওয়া হয় আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু ঐ বাড়িকেই নয়, গ্রাস করে রবিনকেও।
মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলেন মেহেদী হাসান রবিন। পুড়ে যায় শরীরের উপরের অংশ। আগের দিন শহরের আন্দোলনে যিনি ছিলেন প্রাণ পুরুষ, পরদিন অসহ্য জ্বালায় কাতর তিনি। বিকেলে অল্প সময়ের জন্যে নাটোর আধুনিক হাসপাতাল, এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সবশেষে ঢাকার বার্ণ হাসপাতাল। সেখানেই নিভে যায় রবিনের জীবন প্রদীপ।
অগ্নিদগ্ধ শহীদ রবিনকে উদ্ধার করা গেলেও অনেক জুলাই যোদ্ধা নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি হয়ে উঠে বিষাদময়। অজানা শঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটে বাড়ির সদস্যদের। সারা রাত ধরে চলে খোঁজাখুজি। থানায় নেই, আর্মি ক্যাম্পে নেই, হাসপাতালে নেই, কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নেই। কোথাও নেই।
সিটি কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খানকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ইন্ধনদাতা হিসেবে পুলিশ ২৮ জুলাই গ্রেফতার করে। উদ্বিগ্ন মা ডেজি খাতুন সদ্য এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলে আকিবকে বিকেল পাঁচটা থেকে ফোনে আর পাননি। কিন্তু কখনো ভাবতে পারেননি, ছেলে নেই। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয় খোঁজাখুজি। পরদিন সকালে শিমুলের বাড়ির দোতলায় পাওয়া যায় আকিবের অঙ্গার দেহ। তালিকায় নাম লেখা হয় শহীদ মিকদাদ হোসেন খান আকিব।
একই বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান আরো দুই শিক্ষার্থী। শহীদ ইয়াসিন আলী গ্রীন একাডেমি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং শহীদ শাওন খান সিয়াম মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ স্কুল ও কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফারহান ফুয়াদ বলেন, আন্দোলনে যেয়ে আমি ফিরে আসলেও আমার বাবা শহীদ শরিফুল ইসলাম মোহন শিমুলের বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
একই স্থানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো পাঁচ শহীদ দেশের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। এই গৌরব গাঁথা রয়ে যাবে মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতি ফলকে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারানোর স্থানটিতে প্রত্যেক শহীদের নামে সরকার পৃথকভাবে নির্মাণ করছে ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’-যেখানে শহীদদের জন্ম, মৃত্যু তারিখ আর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জ্বলজ্বল করে জ্বলবে চিরদিন।