শিরোনাম
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান
খুলনা, ২৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস): বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বিভাগীয় শহর খুলনাও বাদ ছিল না এ আন্দোলন থেকে। ২৬ জুলাই আন্দোলনটি ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও জিরোপয়েন্ট কেন্দ্রিক। সেদিন পুলিশের গণগ্রেপ্তারের কারণে শহরজুড়ে ছিল আতঙ্ক। ওই দিন রাতে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। গ্রেফতার করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাতজন নেতাকে। কথিত সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়ের করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। এভাবেই একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে পুলিশের গ্রেফতার ও নির্যাতন এ দুয়ের মধ্য দিয়ে খুলনা শহরে অতিবাহিত হয় চব্বিশের ২৬ জুলাই।
কোটা বিরোধী আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ২৬ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে নগরীর প্রবেশপথ জিরো পয়েন্ট মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা। এদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, বি এল কলেজ এর শিক্ষার্থীদের সমাগমে ব্যাপক ছাত্র সমাবেশ ঘটে। প্রায় দুই থেকে তিন হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীরা নানা শ্লোগানে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। ‘কোটা দিয়ে বৈষম্য নয়, বৈষম্যমুক্ত দেশ চাই’, ’আমার সোনার বাংলায়, কোটা প্রথার ঠাঁই নাই’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘শিক্ষার্থীদের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ,’ ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ এমন সব শ্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতা ও নাশকতা সৃষ্টিসহ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি)’র খালিশপুর থানা পুলিশ ৭ জনকে গ্রেফতার করে।
কেএমপি সূত্রে জানা যায়, ২৫ জুলাই রাতে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর খালিশপুর থানাধীন ২০ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময়
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ৭ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, খালিশপুর থানাধীন ১১৩ নম্বর সড়কের মো. আবু জাফরের পুত্র মো. কামরুজ্জামান (৩৩), একই এলাকার রুস্তম আলীর পুত্র এমজি সরোয়ার (৫০), সাতক্ষীরা আশাশুনি থানাধীন প্রতাপনগর এলাকার খোকন মিস্ত্রীর পুত্র মো. নাহিদ ইসলাম(১৯), খুলনার কয়রা থানাধীন ঘুগরাকাটি এলাকার আমজাদ মোড়লের পুত্র মো. আবির হোসেন (২১), বাগেরহাট রামপাল থানাধীন গৌরম্ভা এলাকার শেখ মুস্তাক আহমেদের পুত্র শেখ মুয়াজ (১৯), সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানাধীন গাবুরার মো. মোকাররম হোসেনের পুত্র আবু নাইম (১৯) এবং যশোর কেশবপুর থানাধীন ঝিকরা এলাকার আ. গফফার মোড়লের পুত্র মো. ইকরামুল ইসলাম (৩০)। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে আরো অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
কেএমপি আরো জানায়, অভিযানে খালিশপুরের ওই বাড়ির নিচতলা থেকে কথিত সরকার বিরোধী বিভিন্ন উসকানিমূলক ‘প্রেরণা’ নামক ৩১টি বই, সত্যের সাক্ষ্য নামক ১টি বই, সরকার বিরোধী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার ৩টি ডাইরি, ব্যক্তিগত ৯টি রিপোর্ট বই, ৮২ পৃষ্ঠার ১টি মাসিক রিপোর্ট ফরম, ২টি ল্যাপটপ, একটি টাচ ফোন এবং ২টি লোহার চাপাতি আলামত হিসেবে উদ্ধার দেখায়। পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়।
সেসময়কার কর্তব্যরত পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ‘গ্রেফতারকৃতরা খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে আসামি মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে দৌলতপুর থানাধীন নতুন রাস্তার মোড়ে এবং সোনাডাঙ্গা থানাধীন শিববাড়ী মোড়ে ছাত্রদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছিল। আসামীরা পরস্পর যোগসাজশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ শেষে পুনরায় খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছিল।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় খুলনা বিভাগে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ১৮টি মামলায় ২৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে খুলনা জেলায় কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় তিনটি মামলায় ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা খুলনার বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যায়ের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র নেতাকর্মী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন খুলনার সমন্বয়ক আহাম্মদ হামিম রাহাত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের 'রাজাকার' গালি দেয়ার প্রতিবাদে খুলনার শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। যার অংশ হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টে ব্লকেড করে। পরবর্তীতে ওই আন্দোলন শিববাড়ি মোড়ে নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি ও আলপনা আঁকা হয়।’