বাসস
  ১৮ জুলাই ২০২৫, ১৯:২১
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৭:৪২

সাভারের রাজপথে ঘাতকের বুলেটে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ হন শিক্ষার্থী ইয়ামিন

শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। ফাইল ছবি

প্রতিবেদন : রুপোকুর রহমান

সাভার, ১৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : আজ ১৮ জুলাই শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২৪ সালে আজকের এইদিনে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন সাভারে এমআইএসটি’র মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। 

গত বছরের ১৮ জুলাই ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলছিল। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সাভারসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। সব জায়গার মতো সাভারেও চলছিল শিক্ষার্থী ও জনতার দুর্বার আন্দোলন।

পুলিশের সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলার সময় পুলিশ নির্বিচারে বৃষ্টির মতো একাধারে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এরমধ্যেই আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতশত ছাত্র-ছাত্রী সড়কে নেমে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পুলিশ, র‌্যাব ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ইট-পাথর দিয়ে প্রতিহত করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সাভারের বিভিন্ন সড়ক।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-জনতাকে লক্ষ্য করে পুলিশ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা যখন গুলি ছুড়তে থাকে তখন গুলি থামাতে পুলিশের সাঁজোয়া যান এপিসিতে উঠে পড়ে রাজধানী মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন। এসময় ঘাতক পুলিশ খুব কাছ থেকে ইয়ামিনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।

ফাইল ছবি

ইয়ামিন যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল তখন পুলিশের এক সদস্য একপর্যায়ে পুলিশের এপিসি থেকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে নিচে রাস্তায় ফেলে দেয়। তখনও ছটফট করছিল ইয়ামিন। এর কিছুক্ষণ পরই ইয়ামিন শহীদ হন।

দুপুর ২টার দিকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজা মোড়ের কাছেই মনসুর মার্কেটের সামনে ঢাকা জেলা পুলিশের একটি রায়ট কন্ট্রোল কার (এপিসি), ঢাকা জেলা ১৪ নামের মার্কিং করা গাড়িটির ওপর ইয়ামিনের দেহটি দেখা যায়। কালো জামা, নীল প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় ইয়ামিনের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহটি এসময় এপিসির ওপর আটকে ছিল। এই আটকে থাকা দেহ নিয়েই পুলিশের রায়ট কারটি পেছনে ফিরে আসে। একটু পিছিয়ে পাকিজা মোড়ে থামে। সামনে হাজারো মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে এসময় পুরো পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

পুলিশের সাঁজোয়া যানটি থামিয়ে সাইড থেকে এক পুলিশ বেরিয়ে আসে। এসময় সাজোয়া যানের ওপর থেকে আরেক পুলিশ সদস্য বেড়িয়ে এসে ইয়ামিনের নিথর দেহটা সরানোর চেষ্টা করে। সাইডের গেট খুলে বের হওয়া এক পুলিশ সদস্য ইয়ামিনের নিথর দেহটার প্যান্টে হ্যাচকা টান দিয়ে কারের ওপর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়।

এপিসির ঠিক পাশেই নিচে পড়ে দেহটা। এপিসির চাকার সাথে লেগে থাকায় আবার টেনে-হিঁচড়ে আরেকটু সাইডে আনা হয়। তখনও ইয়ামিনের দেহে প্রাণ ছিল। পরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন নিমর্মম মৃত্যুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ভিন্ন মাত্রা পায়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে পুরো দেশজুড়ে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে।

শহীদ ইয়ামিনের মৃত্যুর এক বছর পূর্তিতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কবরস্থান জিয়ারতসহ স্থানীয় ব্যাংকটাউন মসজিদে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। শোক সভা, আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোও।

এমআইএসটির এই মেধাবী শিক্ষার্থীর নির্মম মৃত্যুর পরও তার লাশ নিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের। প্রথমে মৃত্যু সনদ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে সাভার তালবাগ মুসলিম কবরস্থানে লাশ দাফন করতে গেলে বাধা দেয় তৎকালীন কবরস্থান কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা যুবলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান।

পরে এক বন্ধুর সহায়তায় উপয়ান্তর না পেয়ে ব্যাংকটাউন আবাসিক এলাকায় নিজের সন্তানের লাশ দাফন করেন শহীদ ইয়ামিনের হতভাগ্য বাবা। ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগীদের বাধার কারণে সুন্দর করে জানাজাটাও পড়তে পারেননি ইয়ামিনের স্বজন, সহপাঠী ও সহযোদ্ধারা।

রাজধানী মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী। জন্ম ২০০১ সালের ডিসেম্বরে। তার বাবার নাম মো. মহিউদ্দিন। তিনি সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা।

শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের এক বোন রয়েছে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ইয়ামিন ছিলেন ছোট। তিনি সাভারের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। বুয়েট ও রংপুর মেডিকেলে চান্স পেলেও ভর্তি হয়েছিল মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। বসবাস করতেন বাবা-মা ও বোনের সাথে সাভারের ব্যাংক টাউনে।

শহীদ ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন জানান, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ইয়ামিন ছিল আমাদের সকলের অনেক আদরের। সেদিন জোহরের নামাজের পর আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। পরে এনাম মেডিকেল থেকে তার নিথর দেহ বাড়ী নিয়ে এসেছিলাম। 

মো. মহিউদ্দিন বলেন, যুবলীগ নেতা মিজানের কারণে তালবাগ কবরস্থানে লাশ দাফন করতে গিয়ে করতে পারিনি। পরে কাফন ছাড়া রক্তমাখা কাপড়েই ইয়ামিনের মৃতদেহ এক বন্ধুর সহায়তায় ব্যাংকটাউনে দাফন করি। কারণ ইয়ামিন শহীদ হয়েছে। আর ইসলামে শহীদদের রক্তমাখা কাপড়কেই কাফন হিসেবে ধরা হয়।

সন্তান হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে মো. মহিউদ্দিন বলেন, ঘাতকের বুলেটের আঘাতে আর কোন বাবা-মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়। আর যেন কোন বাবা-মা এভাবে আমার মতো কস্ট না পায়।

দেশব্যাপী বহুল আলোচিত শহীদ ইয়ামিন হত্যার মামলাটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন রয়েছে। মামলার তদন্তে ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গেল ১২ জুলাই গুলি সম্পৃক্ততার অপরাধে পুলিশ কনস্টেবল মাহফুজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামী ১২ আগস্ট এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য করেছেন বিজ্ঞ আদালত।