বাসস
  ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:৫৮
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১৩:২১

পুলিশ-লীগের নৃশংসতার শিকার মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও : আশরাফ মাহদী

মাওলানা আশরাফ মাহদী। ছবি : ফেসবুক

পলিয়ার ওয়াহিদ

ঢাকা, ১৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন এদেশের আপামর ছাত্র-জনতা। সেই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের সাহসী ও সংগ্রামী কার্যক্রম স্বৈরাচারের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। সেই সময় হাজারো শিক্ষার্থীকে সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনায় যেসব শিক্ষার্থী সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও তরুণ আলেম প্রজন্ম-২৪ এর সভাপতি পর্ষদ সদস্য ও সাধারণ আলেম সমাজের যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা আশরাফ মাহদী।

আশরাফ মাহদীর জন্ম ২২ মে ১৯৯৩ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে। লেখাপড়া করেছেন দাওরা হাদিস ও ইফতা জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসা থেকে। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মার্স্টাস ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। এছাড়া উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন  মিশরের কায়রো আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গড়ে উঠা নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র (বাসস) বিশেষ আয়োজন ‘জুলাই জাগরণ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন মাওলানা আশরাফ মাহদী। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন পলিয়ার ওয়াহিদ।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রায় ১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। জুলাইয়ের সেই সংগ্রামী সময়ের স্মৃতি কতটা অনুভব করেন?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : জুলাই যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি তো এখনো বেশ তরতাজা। রক্তাক্ত সে রাজপথের দৃশ্য নিউজফিডে যখন বারবার ঘুরে ফিরে আসতে থাকে তখন অনুভবে আবারও সে সময়টাতে ফিরে যাই।

সাধারণ আলেম সমাজের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সংহতি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। সেদিন দনিয়া কলেজের সামনে সকাল থেকেই অস্ত্র নিয়ে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আওয়ামী প্রশাসন। কর্মসূচি সফল করতে আমাদের কয়েকশ’ গজ দূরে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল। কিন্তু যাত্রাবাড়ীর ওই স্পটে অবস্থান ছত্রভঙ্গ করতে কিছুক্ষণ পরই পুলিশ আর আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর সম্মিলিত হামলা হয়। আমাদের সাথে মিছিলে যুক্ত হওয়া যাত্রাবাড়ীর শতাধিক মাদ্রাসা ছাত্র আহত হয়েছিল সেদিন। শুধুমাত্র ওই একটা স্পটে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন অর্ধ শতাধিক মানুষ।

আমি আন্দোলনের বেশিরভাগ দিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন রাস্তার মোড়ের স্পটটাতে ছিলাম। তখন সবচেয়ে কাছ থেকে শহীদ হতে দেখেছি ১২ বছর বয়সী রাকিবকে। ঠিক মাথায় এসে লেগেছিল গুলিটা। জুলাইয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি সেদিন। এখন ভাবলেও মনে হয় বোনাস লাইফ নিয়ে বেঁচে আছি। হয়তো জুলাই বিপ্লবকে পূর্ণতা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনার সংগঠনের ভূমিকা কি ছিল?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : ২০১৮ থেকে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল এর সাথে সাংগঠনিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে প্রচুর লেখালেখি করেছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। ২০১৮ সালে নুরুল হক নূরের পক্ষে লেখায়, ফেসবুকে তার ছবি প্রোফাইল পিকচার দেওয়ায় আমাকে ডিবি থেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। আমি সরকারের সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়া লেখালেখি করার ফলে ২০২০ সালে গ্রেপ্তার ও গুমের শিকার হতে হয়। গুম পরবর্তী সময়ে ডিবি অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। মাসের পর মাস পাসপোর্ট, মোবাইল ও ল্যাপটপ বিনা কারণে জব্দ করে রাখা হয়।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিল। বিশেষ করে ১৬ জুলাই যখন ঢাবি ক্যাম্পাস রক্তাক্ত এবং হাসিনার নির্দেশে ছয়জনকে হত্যা করা হয়।

পরদিন সকাল ছয়টা থেকেই যাত্রাবাড়ী দখলে নিয়েছিল যাত্রাবাড়ী মাদ্রসার ছাত্ররা। দনিয়া কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেয়। প্রথম দিকে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবেই অংশগ্রহণ করেছি আমরা। অনেকে পোশাক পরিবর্তন করেও নেমেছে যাতে এটাকে ভিন্ন কোনো ট্যাগ দিয়ে দমনের বৈধতা তৈরি না করা যায়। পরবর্তীতে ছাত্র জমিয়ত, ছাত্র মজলিস, সাধারণ আলেম সমাজ ও বৈষম্যবিরোধী কওমী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারেও নেমেছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো স্মৃতি জানাতে চাই।

মাওলানা আশরাফ মাহদী : আগস্টের প্রথম দিন থেকেই বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ হচ্ছিল। যাত্রাবাড়ীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সমন্বিত ভূমিকার ফলেই সেখানে বড় পরিসরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। ওয়াহিদ ভাই ৪ তারিখে জানান যে ঢাকার বাইরে থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে যারা আসছেন তাদের রিসিভ করার ব্যবস্থা করতে। সর্বশক্তি দিয়ে ঢাকার প্রবেশদ্বার যাত্রাবাড়ী অবরোধ করা হবে আগামীকাল। কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম থেকে ছাত্রদলের সম্রাট ভাই জানালেন উনারা রওনা দিচ্ছেন। পরামর্শ করলেন ঢাকায় এসে কোথায় অবস্থান করবেন। আমি যেকোন মূল্যে ফজরের আগে এসে পৌঁছানোর কথা বলি।

তখন যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার শিক্ষক ও সাধারণ আলেম সমাজের আহ্বায়ক মাওলানা রিদওয়ান হাসান ভাইকে জানাই। উনি রিসিভ করে মাদ্রাসায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা নেন। এরপর আমি ফেসবুকে বেশ কয়েকটা দিক-নির্দেশনামূলক পোষ্ট দেই। এ ক্ষেত্রে আমি ২০১৩ সালে নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়েছিলাম। আমার স্মৃতিতে শাপলার সময় নেতৃবৃন্দের যেসব নির্দেশনা স্মরণে ছিল সব আমি একে একে পোস্ট করতে থাকি।

মাদ্রাসাগুলোকে ঢাকার বাইরে থেকে আগত মেহমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানাই। পোস্টগুলো তখন ভাইরাল হয়। যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকার প্রবেশদ্বারে যেসব মাদ্রাসা আছে সবাই মেহমানদারীর প্রস্তুতি নেয়। তখন মনে হচ্ছিল শাপলা চত্বরের মতো আরেকটা সুযোগ আমাদের সামনে আসছে। ফজরের আগেই স্পটের নিকটবর্তী মাদ্রাসা-মসজিদগুলোতে অবস্থান নিতে বলি এবং নিজেও পরদিন সকালে দুইটা চিরকুটে নিজের নাম পরিচয় লিখে দুই পকেটে নিয়ে বের হয়ে যাই। রাজপথে সেদিন দেখা হয়েছিল শহীদী তামান্না নিয়ে নেমে আসা মুক্তিকামী তরুণ-যুবকদের সাথে।

বাসস : আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন জুলাইয়ের কত তারিখে?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : আমি প্রথম মিছিলে  শরিক হয়েছি জুলাইয়ের ১৯ তারিখে। মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদ থেকে বড় একটি মিছিল বের হয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত দখলে নিয়েছিল। আমার বাসা এদিকে হওয়াতে আমি একেবারে প্রথম দিন থেকেই এই স্পটে নিয়মিত আন্দোলনে যোগদান করেছি।

তবে এর আগে ১৭ জুলাই থেকেই মাদ্রাসা ছাত্ররা নামতে শুরু করেছিল। যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ও কাজলার রাজপথ দখলে নিয়েছিল মাদ্রাসা ছাত্ররা। এরপর ১৯ জুলাই সারাদেশে ব্যাপকভাবে বাদজুমা ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মুসল্লিদের সাথে নিয়ে মিছিল বের করে মাদ্রাসা ছাত্ররা। এখানে বিশেষভাবে ছাত্র জমিয়ত, ছাত্র মজলিস ও বাংলাদেশ কওমী ছাত্র ফোরামের ভূমিকা স্মরণ করতে হবে।

বাসস : আন্দোলনে আপনার সামনে শহীদ হয়েছেন এমন কোনো স্মৃতি আছে? থাকলে সেই শহীদ কে?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : টিয়া রঙের এক জোড়া স্যান্ডেলের দুঃসহ স্মৃতিটা ভুলতে পারি না। আমি ছোট্ট সেই স্যান্ডেল জোড়ার ছবি তুলে রেখেছি। ১৯ জুলাই সন্ধ্যার পর মোহাম্মদপুরে ১২ বছর বয়সী শহীদ রাকিবের মাথায় গুলি লাগে। আমি দেখলাম ছোট্ট ছেলেটার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে অনবরত। একজন জার্সি নিয়ে এসে চেপে ধরলো।

রক্ত কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এরপর কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে আল মানার হসপিটালের দিকে নিয়ে যায়। আমি তখন রাস্তার অপর পাশ দিয়ে হেঁটে সমবেত ছাত্র জনতার দিকে যাচ্ছিলাম। রাকিব যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল সেখানে পুলিশ ফায়ার করেনি। কিন্তু কোত্থেকে গুলিটা এসে লাগলো আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আহত রাকিবের মাথা থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে রাস্তায় পড়ছিল। রাকিবকে আমরা সেদিন বাঁচাতে পারিনি। পরে মানবজমিনের এক রিপোর্ট থেকে জানতে পারি, হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া সাউন্ড গ্রেনেডে ছোট্ট রাকিবের মাথার খুলি সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এবং র‌্যাব এর দায় স্বীকার করেছিল।

বাসস : জুলাইযোদ্ধা হিসেবে কি এক দফা ঘোষণার আগে বুঝতে পেরেছিলেন হাসিনা পালিয়ে যাবে?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : হাসিনার পতন এবার হবে, এই আত্মবিশ্বাস পাই ১৮ জুলাই। যখন ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর ছাত্রদের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বস্তরের জনগণ নেমে আসতে শুরু করে। একইসাথে রাজনৈতিক-সামাজিক ও ধর্মীয় শক্তিগুলো অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এবং বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয় যখন অনেক চেষ্টা করেও আন্দোলন আর এর নেতৃত্বকে বিতর্কিত করা যাচ্ছিল না। হাসিনার পরিকল্পনা একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছিল। রাজাকারের নাতিপুতি থেকে শুরু করে মেট্রোরেল নিয়ে মায়া কান্না, সব নাটক ধারাবাহিকভাবে বুমেরাং হচ্ছিল। ছাত্রনেতাদের সাথে আলোচনার দুয়ার খুলে বসে থেকেও তখন কোনো সাড়া পাচ্ছিল না হাসিনা। কারণ ২০১৩ ও ২০২১ সালে আমি হাসিনার আন্দোলন দমনের কৌশল  খুব কাছ থেকে দেখেছি। হাসিনা তার পুরো ১৬ বছরের সময়কালে একসাথে এতদিক থেকে কখনো ব্যর্থ হয় নাই। তবে এটাও সত্য যে আমরা আন্দোলনকারীরাও নো রিটার্ন পয়েন্টে ছিলাম। হাসিনাকে এবার ক্ষমতা থেকে নামাবোই, এই বিশ্বাস ছাড়া আমাদের কোনো সেকেন্ড অপশন ছিল না। আমি সেন্ট্রালের সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম তুহিন আর লুৎফরের মাধ্যমে। সরকার পতনের যে ছকে আমরা আগাচ্ছিলাম সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগও ছিল না।

বাসস  : ৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাই সকালে কোথায় আন্দোলন করেন? হাসিনা পালানোর খবর কখন পান, কেমন অনুভূতি হয়?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : সকালে আমি মোহাম্মদপুরে আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে ছাত্র-জনতার অবস্থানে যোগ দেই। সেদিন পুলিশ ও আর্মি আরও বেশি জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদেরকে বেড়িবাঁধের দিকে আরেকটু সরে আসতে হয়। কিন্তু আর্মি সামনে থাকায় পুলিশের গুলি করার আশঙ্কাটা কম ছিল। 

আমি সেদিন সকালে দুই পকেটে দুইটা চিরকুট লিখে প্রস্তুত হয়েই বের হই। দুপুর একটায় জাতির উদ্দেশ্যে সেনা প্রধানের বক্তব্য দেওয়ার কথা। ১২টার পর থেকে হঠাৎ খেয়াল করলাম রাস্তায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ছে। একটার দিকে একজন অফিসার বলে উঠলো আরেকটু অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেব। বিজয়ের আভাস পেলাম মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর এক পাশে জনতার একটা জটলা থেকে স্লোগান শুনতে পেলাম, ‘পালাইছেরে পালাইছে, শেখ হাসিনা পালাইছে।’  দীর্ঘ এক যুগ প্রতীক্ষার পর নিজ চোখে দেখা এই আনন্দঘন মুহূর্তটা ধরে রাখতে ভিডিও করে রাখলাম।

বাসস : আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : যাত্রাবাড়ীতে আমরা ২ আগস্ট যখন সাধারণ আলেম সমাজের কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম তখন ছাত্রলীগের হামলা প্রতিহত করার মতো কোনো প্রস্তুতি ছিল না আমাদের। দনিয়া কলেজে অস্ত্রের মহড়া দেখে আমরা কিছুটা সরে এসে অবস্থান করেছিলাম।

তবে আন্দোলনের ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে প্রায় পুরোটা সময় আমি মোহাম্মদপুরেই ছিলাম। তখন মাদ্রাসার ছাত্ররা জনতার সাথে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর কৃতিত্ব বিহারি ক্যাম্প আর বস্তি থেকে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া অদম্য সাহসী ছেলেগুলোকে অবশ্যই দিতে হবে। বেশ কয়েকদিন মোহাম্মদপুরের খুনি কমিশনার আসিফ তার গুন্ডাবাহিনী নিয়ে আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে পুলিশের সাথে মিলে হামলা চালিয়েছে। তখন টায়ার জালিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ করেছিল ছাত্ররা। সে সময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় বিভিন্ন সময় আসিফের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে ধরে এনে গণধোলাই দেয় ছাত্র-জনতা। আসিফ সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকবার সরাসরি আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়ে।

বাসস :  বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি কেন?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীরা রাজপথের চেয়ে অনলাইনে বেশি একটিভ ছিল। বিপ্লবী লিখনীর মাধ্যমে আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে। আর যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে বোরকা পরেই রাজপথে নেমে এসেছে। আমরা আন্দোলনের সময়কার ছবিগুলোতে অনেকের অংশগ্রহণ দেখতে পাই।

তবে লীগ-প্রশাসন কর্তৃক চালানো নৃশংস আচরণের শিকার হয়েছে মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। আন্দোলনের দিনগুলোতে যাত্রাবাড়ীর ছনটেক মহিলা মাদ্রাসাসহ অন্তত তিনটি মহিলা মাদ্রাসার বিষয়ে আমরা সংবাদ পেয়েছি। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও সুপরিচিত জামিয়া আশরাফুল উলুম ছনটেক মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের জায়গা থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় তারা মাদ্রাসার ক্যান্টিন থেকে আন্দোলনকারীদের পানি বিস্কুট সরবরাহের পাশাপাশি  সাধ্য মতো অন্যান্য সহযোগিতা করেছে। এই মাদ্রসার প্রতিষ্ঠাতা আলেম মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা আব্দুর রহমান ও প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহমানী ও আরেকজন সাধারণ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করতে একদিন সন্ধায় শতাধিক পুলিশ এসে মাদ্রাসাটি ঘেরাও করে। মাদ্রাসা থেকে যেন কেউ বের না হয়, এমন হুমকি দিয়ে যায়। একদিন মধ্যরাতে যাত্রাবাড়ী ছনটেক মহিলা মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আমাকে টেক্সট করেন জানান, সেখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল ও একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 
এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীতে রিতা আক্তার নামে একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শহীদও হয়েছেন। তরুণ আলেম প্রজন্ম ২৪ কর্তৃক প্রকাশিত গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নামের তালিকায় প্রথমেই তার নামটা রেখেছি আমরা।

বাসস : কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন জোরালো হয়। তাদের সম্পর্কে শুনতে চাই।

মাওলানা আশরাফ মাহদী : আপনারা জানেন সাধারণ স্কুল-কলেজের মতো মাদ্রাসার ছাত্রদের এত স্বাধীনতা থাকে না।  ফলে প্রথম থেকে শিক্ষার্থীরা নামতে চাইলেও পারেনি।

কারণ মাদ্রাসার ছাত্ররা হুজুরদের জিম্মায় থাকেন। কিন্তু তারা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? অনেক মাদ্রাসা ছাত্ররা চুরি করে ১৭ তারিখ যাত্রাবাড়ীতে প্রথম আন্দোলনে যোগ দেয়। তবে ১৮ তারিখ হেফাজতের আমীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে বিবৃতি প্রদান করার পর কওমী মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দ স্বত:স্ফূর্তভাবে আন্দোলনে নেমে আসে। বাদ আসর মাদ্রাসা ছাত্রদের সবচেয়ে বড় মিছিল বের হয়েছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে। এ ছাড়াও ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বারিধারা, বাড্ডা,  ফরিদাবাদ ও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখান বাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামেয়া ইউনুসিয়া, খুলনা দারুল উলুম থেকে জুলাইয়ে সিসাঢালা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা।

কওমী শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শহিদী তামান্না নিয়ে গিয়েছিল। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে যাত্রাবাড়ীর শহীদ হাফেজ খুবাইব। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সিলসিলা উজানী পীর বংশের সন্তান ছিলেন তিনি। ইন্তেকালের আগের রাতে মাকে সে বলেছিল ‘আম্মা, আপনারা না আমার নাম খুবাইব রেখেছেন? আম্মা, আপনি আমার জন্য দোয়া করেন, মায়ের দোয়া তো কবুল হয়, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।

মায়ের দোয়া নেওয়ার ঠিক পর দিন ৫ আগস্ট থানার সামনে পুলিশের সরাসরি গুলিতে শহীদ হয় হাফেজ খুবাইব। আমরা ভিডিও ক্লিপটিতে সাদা জুব্বা পরিহিত খুবাইবকে পড়ে থাকতে দেখেছি। এভাবে আন্দোলন দমনের নামে শতাধিক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের শহীদ করেছিল পুলিশ বাহিনী। পরবর্তীতে আমরা জানতে পাই ১৩ সালের মতো ২৪ সালেও হাসিনার নির্দেশেই নিরস্ত্র জনগণকে নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল।

বাসস : আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আপনি কি ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : আমি অনলাইনেও খুব একটিভ ছিলাম। ইনবক্স ও কমেন্ট বক্সে অনেক হুমকি আসতো। এসব পরোয়া করি নাই। তবে আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে আমার জীবন নিয়ে আশঙ্কা করতেন। সাবধানে থাকতে বলতেন। আমরা আন্দোলনের পুরো সময়টাতেই আতংকের মধ্যে ছিলাম। রাত হলেই শুনতে পেতাম বাসায় এসে অমুককে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। আমি প্রতিরাতেই গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। কেউ দরজায় নক করলে যেন ভিডিও অন করে অন্ধকারে থেকে ভিডিও করা হয় এটা পরিবারের সদস্যদের বলে রেখেছিলাম।

বাসস : আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের জন্য আপনারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : ৫ আগস্টের পরই আমি ও আমার সহযোদ্ধা ত্বহা মাহমুদ গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া মাদ্রাসার আলেম-শিক্ষার্থীদের  তালিকা করা শুরু করি। সপ্তাহ খানেক পর যখন সংখ্যাটা পঞ্চাশ পেরিয়ে যায় তখন তরুণ আলেম প্রজন্ম-২৪ সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনগুলোর সাবেক ছাত্র নেতাদের একটি প্লাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়। এই প্লাটফর্মে আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব সংগঠন ও মাদ্রাসা প্রতিনিধিরা রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে একত্রিত করি। যাতে জুলাইয়ের স্পিরিট সমুন্নত রাখতে জুলাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবদান ও প্রত্যাশাকে সামনে রেখে কাজ করা যায়। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৭ জন শহীদের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করি। এই তালিকার কাজ এখনো চলমান রয়েছে। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শহীদের সংখ্যা ৯২ জনে দাঁড়িয়েছে।

আমরা তালিকা প্রকাশের দিন দশটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে হাদিয়া দিই। এছাড়াও জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে ও সরকারি তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সাধ্য মতো সহায়তা করি।

বাসস : গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কতটা বাস্তবায়ন হলো?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। তা পূরণে ব্যর্থ হলেই প্রতি বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশে এমন কোনো ঘটনা বিগত ১০ মাসে না ঘটায় বোঝা যাচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মানুষ কিছুটা হলেও আশাবাদী হতে পেরেছে। তবে একই সাথে এটাও সত্য যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে  ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ নিশ্চিত করার যে প্রত্যাশা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে তার নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নীরব। ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরেই দেশ দ্বিতীয় বার স্বাধীন হয়েছে। অতএব ছাত্রনেতৃত্ব তৈরি ও বিকশিত হওয়ার পরিবেশ থাকাটা অনিবার্য। সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ না নিতে পারলে তরুণ নেতৃত্বে থেকে দেশ জাতি উপকৃত হতে পারবে না।

বাসস : স্বৈরাচার পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কি?

মাওলানা আশরাফ মাহদী : ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বিভাজনের রাজনীতিকে পেছনে ফেলে এক কাতারে আসতে পারার কারণে।

এই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণেও  দেশের স্বার্থে সকল বিভাজনকে একপাশে রাখতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে যখন দায়িত্বশীল জায়গা থেকে সকল অংশীজনকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সাথে ফ্যাসিবাদী আমলে রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, সেগুলোও পুনর্গঠন করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে ক্ষমতাসিন রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিকরা আর জিম্মি হবে না। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা হলো সকল জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার নিশ্চিত এবং  ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।

বাসস : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মাওলানা আশরাফ মাহদী : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।