বাসস
  ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৫
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৫১

নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে চালু হচ্ছে এআই পদ্ধতির চিকিৎসা সেবা : নিন্স পরিচালক

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ । ছবি : বাসস

।। বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ।।

ঢাকা, ৯ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির আশীর্বাদে মানুষের কাজের সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি জীবন হয়েছে সহজ। মানুষের ব্যক্তিগত, পেশাগত জীবনে এআই’র ইতিবাচক প্রভাব প্রতিনিয়তই বাড়ছে। চিকিৎসার মতো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ খাতে এআই প্রযুক্তির সাফল্যের খবরও এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। 

এরই ধারাবাহিকতায় স্ট্রোকের রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালে এবার চালু হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই পদ্ধতির চিকিৎসা সেবা। শিগগিরই হাসপাতালটিতে এই চিকিৎসা সেবা চালু করা হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে স্ট্রোকের রোগীদের জন্য দ্রুতই এআই পদ্ধতির চিকিৎসা সেবা চালু করা হবে। এ পদ্ধতিতে আমরা সিটি স্ক্যান মেশিনের সাথে একটি বিশেষ ডিভাইস যুক্ত করে দেব, যার সাথে সার্ভারের সংযোগ থাকবে। ওই সার্ভারে কোনো রোগী সিটিস্ক্যান করলে তার ব্রেইন স্ট্রোকের মাত্রা ডিভাইসটিতে ভেসে উঠবে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর মাধ্যমে রোগীর যাবতীয় তথ্য আগে সার্ভারে যাবে। সেখান থেকে প্রসেস হয়ে রোগীর পরবর্তী চিকিৎসা সেবা নির্ধারণ করা হবে।’  

কাজী গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, স্নায়ুরোগ চিকিৎসা ইনভেস্টিগেশনের যে ফ্যাসিলিটিস রয়েছে, তার ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশে চলে এসেছে। এখন আমরা এই ইনভেস্টিগেশনগুলো এআই মেডিয়েটেড সফটওয়্যারের মাধ্যমে করবো। স্ট্রোক করা রোগীদের দ্রুত মেকানিক্যাল থ্রমবেকটমি (এমটি) নামে একটি প্রসিডিউর রয়েছে।

ইতোমধ্যে মেকানিক্যাল থ্রমবেকটমি আমাদের হসপিটালে চালু করছি, যার মাধ্যমে জমাটবদ্ধ রক্তের দলা সহজেই বের করা সম্ভব। এর এডভান্সমেন্ট হচ্ছে ব্রেইনের কোন জায়গা থেকে জমাট রক্ত বের করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে তা বুঝতে পারা। রক্ত জমাটের পরিমাণ বা ‘কোর ভলিউম’ মাপতেও এআই প্রযুক্তি সহায়তা দেবে। এজন্য আমরা সিটি স্ক্যান মেশিনে ওই প্রোগ্রামটা স্যাটেল করে দিচ্ছি।  

দেশে স্নায়ু রোগীর সংখ্যা দিন দিন কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে স্নায়ু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো স্ট্রোক। এর যে মেইন রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো রয়েছে তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের কোলেস্টেরল অন্যতম। আমাদের খাবারের মধ্যে অতিরিক্ত চর্বি থাকার প্রবণতা যাকে আমরা ট্রান্সফ্যাট বলি, তা কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। বিশেষ করে খারাপ কোলেস্টেরল বা লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এলডিএল) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় হচ্ছে ট্রান্সফ্যাট। 

তিনি বলেন, নাগরিক জীবনে অধিকাংশ মানুষ আগে যেভাবে সময়মতো ঘুমাতো, বিশ্রাম নিতো, সে জিনিসটা এখন কমে গেছে। এখন অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারসহ বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহারের প্রতি মানুষ অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে। অনেকে রাতে না ঘুমিয়ে কাজ করে। রাতের ঘুমটা যদি স্বাভাবিক সময়ে না হয় সেক্ষেত্রে ব্রেইনে হাইপোথ্যালামাসের সমস্যা হয়। হাইপোথ্যালামাস ব্রেইনের সকল সেন্টার ও হরমোনাল সেন্টারগুলোকে কন্ট্রোল করে। এটি যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে জটিলতা দেখা দেয়, যা ধীরে ধীরে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। বর্তমানে উন্নত ইনভেস্টিগেশন সুবিধার ফলে আমরা তরুণদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখছি, যাদের ক্ষেত্রে রক্তনালীর সমস্যাই এর মূল কারণ।

স্নায়ু রোগীদের চিকিৎসায় দেশে বিশেষায়িত হাসাপাতালের প্রয়োজন আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমি মনে করি ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ সকল বিভাগীয় শহর কিংবা বড় বড় জেলা শহরগুলোতে এ ধরনের বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু করা গেলে অনেক মানুষ উপকৃত হবে।

এছাড়াও আমাদের দেশে যে সকল মেডিকেল কলেজ রয়েছে সেখানে স্নায়ু রোগীদের চিকিৎসায় একটি বিশেষ ইউনিট খোলা হলে মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।’  

দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে স্নায়ু রোগীর চিকিৎসায় ইউনিট চালু করার প্রয়োজন আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটি চালু করার সময় চলে এসেছে। শুরুতেই যদি একটি সিটি স্ক্যান করার সুযোগ থাকে এবং সেখানে যদি একজন নিউরোলজিস্ট কিংবা রেডিওলজিস্ট থাকে, তবে কেউ স্ট্রোক করলে শুরুতেই তিনি সঠিক চিকিৎসা পাবেন। স্ট্রোকের রোগীকে যদি জেলা পর্যায়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায় তাহলে ওই রোগীগুলোকে আল্টিমেটলি মেডিকেল পর্যন্ত আসার প্রয়োজন হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘বাইরের দেশে স্ট্রোকের রোগীরা অ্যাম্বুলেন্সে সার্ভিস পেয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে মোবাইল সিটি স্ক্যান মেশিন থাকে যাকে বলা হয় মোবাইল স্ট্রোক ইউনিট।

অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই সিটি স্ক্যান করা হয় এবং সেখান থেকে রিপোর্ট রেডি করে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকরা রিপোর্ট দেখে অনলাইনে নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীকে প্রয়োজনীয় ইনজেকশন দেওয়া হয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই একজন রোগী সঠিক চিকিৎসা পায়। কিন্তু যদি চিকিৎসায় দেরি হয়, তাহলে স্ট্রোকের কারণে অঙ্গহানির মত ঘটনা ঘটতে পারে।’ 

তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো স্ট্রোকের রোগীদের নির্ধারিত নিয়ম মেনে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ইনজেকশন দেওয়া। কিন্তু আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অধিকাংশ রোগী স্ট্রোকের উপসর্গগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। উপসর্গ বুঝতে বুঝতেই প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা কেটে যায়। তখন আর চিকিৎসার উপযুক্ত সময় পাওয়া যায় না। আবার কেউ উপসর্গ বুঝলেও, ঢাকার শহরের জ্যামের কারণে হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া স্ট্রোকের রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়ি জোগাড় করতে সময় নষ্ট হয়। যদি রোগী সময়মতো হাসপাতালে আসতে পারে, তাহলে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বিদেশে যেভাবে দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা (যেমন মোবাইল স্ট্রোক ইউনিট বা বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স) আছে, আমাদের দেশে তা নেই। তাই স্ট্রোকের রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা দিতে হলে যানবাহন ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সড়ক যোগাযোগ সব কিছু একসাথে উন্নত করতে হবে।

স্নায়ু রোগীদের বিপরীতে চিকিৎসকের সংখ্যা যথেষ্ট কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকের সংখ্যা যা আছে তা দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব।

তবে নিউরোসার্জারির জন্য আমাদের ওটির সংখ্যা এবং এনেস্থেশিয়ার জনবল বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে বাড়াতে হবে নার্সের সংখ্যাও। এগুলো যখন আমরা বাড়াতে পারবো তখন আমাদের বাধাগুলোও দূর হয়ে যাবে।

স্নায়ু রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের পরিচালক বলেন, চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাবার গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়া ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যাপ্ত ভিটামিন গ্রহণ করা এবং স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে এমন কার্যকলাপ এড়িয়ে চলাও গুরুত্বপূর্ণ। 

সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, গ্রামে অনেক মানুষ আছে যারা স্ট্রোক কি, এটি কখন হয় কিংবা এর ফলে শরীরের কি অবস্থা হয়, তারা তা জানেন না।

তাই সারাদেশে যদি ক্যাম্পইনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা যায়, তাহলে এর ডিজেবিলিটি অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে। আর এই ক্যাম্পেইনে শিক্ষক, মসজিদের ইমামদের সম্পৃক্ত করা গেলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।