বাসস
  ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৫২
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩০

বই-ব্যাগ ছাড়াই স্কুলে ফিরছে গাজার শিশুরা

ঢাকা, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : কাঁধে ব্যাগ নেই; নেই বই বা ইউনিফর্ম। পরনে ছেঁড়া জামা আর জোড়াতালি দেওয়া প্যান্ট। তবু প্রতিদিন গাজা সিটির ভাঙা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে অস্থায়ী স্কুলে যায় ১১ বছরের লাইয়ান হাজি। 

যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে তার এই পথচলা যেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাঝেও আশার আলো খোঁজার যাত্রা।

লাইয়ান বলে, ‘অন্তত আধা ঘণ্টা কষ্টকরে হাঁটতে হয়। চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ। খুব মন খারাপ হয়। তবু আবার পড়াশোনা করতে পেরে আমি খুশি। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই।’

গাজা সিটি থেকে এএফপি জানায়, দু’বছর ধরে চলা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ বন্ধের পর গাজার শিশুদের জন্য ফের কিছু স্কুল খুলেছে। আল-লুলুয়া আল-কাতামি স্কুলে লায়ানের মত প্রায় ৯শ’ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শুরু করেছে।

তবে এই স্কুল এখন আর আগের সেই স্কুল নেই। দেয়াল ও করিডোরে কোন রঙ নেই, নেই রং-বেরংয়ের আঁকিবুকিও। ভাঙা স্কুলভবনের ভেতরে টাঙানো তাঁবুই এখন তাদের শ্রেণিকক্ষ।

লাইয়ান জানায়, ‘বই নেই, খাতাও নেই। বোমা হামলায় লাইব্রেরি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

এক মাস আগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ এবং গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরাইলি সোদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এলাকাগুলোর শিশুরা ধীরে ধীরে স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে।

১৬ বছরের সাঈদ শেলদানও স্কুলে ফিরতে পেরে আনন্দিত। কিন্তু লায়ানের মত তার কাছেও কোন শিক্ষা উপকরণ নেই। নেই চেয়ার-টেবিল, বিদ্যুৎ কিংবা পানিও।

সে জানায়, ‘প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে পানি সংগ্রহ করতে হয় এবং রুটির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়।’

যুদ্ধের মধ্যে শেলদানের পরিবারকে কমপক্ষে ১০ বার বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। বর্তমানে তাদের আর কোন বাড়ি নেই।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ৫০ বছর বয়সী ইমান আল-হিনাওয়ি আশা করছেন খুব শিগগিরই বিনামূল্যে বই ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারবেন।

তবে আক্ষেপ করে জানান, যুদ্ধে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী নিহত হওয়ার কারণে গাজার অনেক শিশু ‘কঠোর শ্রম’ করতে বাধ্য হচ্ছে।

জাতিসংঘ যেখানে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছিল, সেই অঞ্চলের শিশুরা এখনও ‘কাঠ কুড়ায়, পানি সংগ্রহ করে, এমনকি খাবারের জন্য লাইনেও দাঁড়ায়।’

এএফপি সংবাদদাতারা সরেজমিনে ঘুরে দেখেন, প্লাস্টিকের বালতি, পুরনো হাঁড়ি কিংবা শুধু প্লেট হাতে অসংখ্য শিশু ভীড়ের মধ্যে কান্না আর চিৎকার করতে করতে তাদের পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করছে।

যদিও শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে স্কুলে নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি চালু হয়েছে। পড়ানো হচ্ছে খেলাধুলার মাধ্যমে। মেয়েরা নাচের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে গণিত সমাধান করছে। কেউবা অভিনয় করে কবিতা আবৃত্তি করছে।

স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফয়সাল আল-কাসাস বলেন, শিশুরা সবসময়ই রুটি ও পানির সংগ্রহের লাইনের চিন্তায় মগ্ন থাকে।

গাজার ৯৭ শতাংশ স্কুল কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেগুলোর বেশিরভাগেরই পুনর্নির্মাণ বা বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।

এসব স্কুলে আশ্রয় নেওয়া বহু ফিলিস্তিনি ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের দাবি, হামাস যোদ্ধারা এসব স্থাপনায় লুকিয়ে ছিল।

স্কুলগুলো মূলত আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন ইউএনআরডব্লিউএ সেখানে অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে।

গত মাসে সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি জানান, ইতোমধ্যে ২৫ হাজার শিশু  পড়াশোনা শুরু করেছে। আরও তিন লাখ শিশু অনলাইনে ক্লাস করবে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গাজায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত লাখ ৫৮ হাজারেরও বেশি।

দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় আন্তর্জাতিক সহায়তা ও স্থানীয় উদ্যোগে শিশুদের স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা চলছে।

‘এডুকেশন অ্যাবাব অল ফাউন্ডেশন’ নামে কাতার ‘রিবিল্ডিং হোপ ফর গাজা’ কর্মসূচি চালু করেছে। এতে ১ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্কুল নির্মাণ সামগ্রী বিতরণ, ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা এবং মানসিক সহায়তা দেওয়া। তবে আল-মাওয়াসির একটি স্কুলে আপাতত আরবি, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান এই চার বিষয় পড়ানো হচ্ছে।

ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হাযেম আবু হাবিব বলেন, ‘প্রাথমিক কোর্স দিয়ে শুরু হলেও আমরা যত বেশি সম্ভব শিক্ষার্থীকে পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনতে চাই।’

যুদ্ধের আগে গাজা নিরক্ষরমুক্ত ছিল। আর এখন শিক্ষাই সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে পড়েছে।