শিরোনাম
ঢাকা, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : দুর্লভ খনিজ বা ‘রেয়ার আর্থ’ এমন এক ধাতু যা চুম্বক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পসহ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সম্প্রতি এই খনিজের খনন, গলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত প্রযুক্তির ওপর রফতানি বিধিনিষেধ আরোপ করে বেইজিং। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি এটিকে ‘চীন বনাম বিশ্ব পরিস্থিতি’ বলেও মন্তব্য করেন।
এগুলো কি সত্যিই বিরল?
আসলে খুব একটা বিরল নয়। ডিসপ্রোসিয়াম, নিওডিমিয়াম ও সেরিয়াম নামের এই রেয়ার আর্থস মূলত ১৭টি ভারী ধাতুর একটি গোষ্ঠী, যা পৃথিবীর ভূ-ত্বকে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ২০২৪ সালে অনুমান করেছে, বিশ্বব্যাপী ১১ কোটি টন রেয়ার আর্থ মজুত রয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ টনই মজুত রয়েছে চীনে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ।
এছাড়া ভিয়েতনামে ২ কোটি ২০ লাখ, ব্রাজিলে ২ কোটি ১০ লাখ, রাশিয়ায় ১ কোটি এবং ভারত প্রায় ৭০ লাখ টন মজুত রয়েছে।
তবে, এই খনিজ উত্তোলনের জন্য বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের ব্যবহার করতে হয়। যা বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি করে এবং তা একাধিক পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে। এছাড়া, উৎপাদনের খরচ বেশি হওয়ায় অনেক দেশ তা বহন করতেও চায় না।
অল্পমাত্রায় খনিজ পেতে হলেও বিপুল পরিমাণ শিলা খনন করতে হয়। এরপর তা পরিশোধন করা হয় যা অধিকাংশ সময়ই গুঁড়ো আকারে থাকে।
কেন বিশেষ?
এই ১৭টি ধাতু টেলিভিশন স্ক্রিন, কাঁচ পোলিশ, তেল পরিশোধন, গাড়ির ক্যাটালিটিক কনভার্টার, গাইডেড মিসাইল, বাল্ব ও টারবাইনসহ দৈনন্দিন ও উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়।
এসব ধাতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। বিকল্প থাকলেও তা এত ব্যয়বহুল যে ব্যবহার করা কঠিন। আবার অনেকক্ষেত্রে সেটি সম্ভব নাও হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, নিওডিমিয়াম এবং ডিসপ্রোসিয়াম ধাতু ব্যবহার করে প্রায় স্থায়ী ও অত্যন্ত শক্তিশালী চুম্বক তৈরি করা সম্ভব। এগুলোর খুব কম রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এর ফলে সমুদ্রের দূরবর্তী স্থানেও বায়ুচালিত ‘টারবাইন’ বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়।
নেতৃত্বে চীন
দশকের পর দশক ধরে, চীন তার মজুত থেকে সর্বাধিক সুবিধা নেয়ার জন্য ব্যাপক পরিমাণে পরিশোধন খাতে বিনিয়োগ করেছে। তবে অনেক সময় এসব কার্যক্রমে অন্য দেশের মতো কঠোর পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ মানা হয়নি।
চীন রেয়ার আর্থ উৎপাদনের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত অনেকগুলো পেটেন্ট (আইনি অধিকার) করেছে। এজন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সহজে বা বড় আকারে এই ধাতুগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে পারছে না। কারণ তারা পেটেন্ট লঙ্ঘন করতে চাইবে না।
ফলে, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের খনিজ চীনে পাঠিয়ে পরিশোধন করাকেই তুলনামূলক সস্তা মনে করছে। এতে চীনের ওপর বিশ্বের নির্ভরতা বাড়ছে।
এপ্রিল থেকে চীন দেশীয় রফতানিকারকদের জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করেছে। এটি মার্কিন শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়ায় করা হয়েছে। কারণ সেসময় রেয়ার আর্থের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ওয়াশিংটনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।
তবে সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। প্রশাসনিক জটিলতা ও বাছাই করে অনুমোদন দেওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান সময়মতো এসব প্রয়োজনীয় উপকরণ পায়নি। চীন নতুন করে রফতানি সীমাবদ্ধতা আরোপের আগেও এই সমস্যা ছিল।
পরবর্তীতে গত জুনে ট্রাম্প ও চীনের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি হয়। সেটির অন্যতম শর্ত ছিল চীন রেয়ার আর্থ ও চুম্বক পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ করবে।
কৌশল ও সরবরাহ
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রয়োজনীয় রেয়ার আর্থস খনিজের বেশিরভাগই চীন থেকে নেয়। দুই পক্ষই এখন নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো এবং ধাতুগুলো পুনর্ব্যবহার করার উদ্যোগও নিচ্ছে যাতে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ চরমে পৌঁছালে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ওয়াশিংটনের পদক্ষেপের প্রতিশোধ হিসেবে রেয়ার আর্থ রফতানি বন্ধ করা হতে পারে। এতে উৎপাদকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।
এর আগে ২০১০ সালে জাপানও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল। সেসময় সীমান্ত বিরোধের জেরে চীন দেশটির কাছে রেয়ার আর্থ রফতানি বন্ধ করে দেয়।
এরপর থেকেই টোকিও সরবরাহের উৎসে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে অস্ট্রেলীয় কোম্পানি লাইনাস-এর সঙ্গে চুক্তি করেছে যাতে মালয়েশিয়া থেকে এসব খনিজ উৎপাদন করা যায়। পাশপাশি জাপান উপাদানগুলো পুনর্ব্যবহার করার সক্ষমতাও বাড়িয়েছে।