শিরোনাম
ঢাকা, ২৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : গাজায় ইসরাইলের হামলায় পাঁচ সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের একটি হাসপাতালে সোমবার এ ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটাকে ‘দুঃখজনক দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
গাজা থেকে এএফপি জানায়, রয়টার্স, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও আল জাজিরা তাদের নিহত সহকর্মীদের প্রতি শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করা হবে।
প্রায় দুই বছর ধরে চলা ইসরাইলি হামলায় গাজায় সাংবাদিকদের জন্য পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর মতে, এই সময়ে প্রায় ২০০ গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন।
বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানান, ‘এখন পর্যন্ত ২০ জন শহীদ হয়েছেন, যার মধ্যে পাঁচজন সাংবাদিক ও একজন বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার সদস্য রয়েছেন।’ হামলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল, যা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কয়েকবার ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের সেনারা ‘নাসের হাসপাতালের এলাকায় একটি হামলা চালিয়েছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সেনাপ্রধান অবিলম্বে একটি প্রাথমিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘তারা বেসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষতির জন্য দুঃখিত এবং তারা সাংবাদিকদেরকে লক্ষ্যবস্তু করে না।’
বাসাল জানায়, হাসপাতালের একটি ভবনে এক ইসরাইলি বিস্ফোরক ড্রোন প্রথমে আঘাত হানে। এরপর আহতদের সরিয়ে নেওয়ার সময় সেখানে বিমান হামলা চালানো হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, তার দেশ ‘আজ নাসের হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এই দুঃখজনক দুর্ঘটনার জন্য গভীরভাবে দুঃখিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরাইল সাংবাদিক, চিকিৎসক ও সকল সাধারণ মানুষের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
রয়টার্স জানিয়েছে, তাদের চুক্তিভিত্তিক ভিডিও সাংবাদিক হুসাম আল-মাসরি হাসপাতালে সরাসরি সম্প্রচার চালাচ্ছিলেন। প্রথম হামলার মুহূর্তেই সম্প্রচার হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
রয়টার্সের এক মুখপাত্র জানান, মাসরির মৃত্যু ও অপর এক চুক্তিভিত্তিক কর্মী হাতেম খালেদ হামলায় আহত হওয়ায় সংস্থাটি ‘অত্যন্ত শোকাহত’।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আমরা জরুরিভাবে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি এবং হাতেমের জরুরি চিকিৎসা সহায়তার জন্য গাজা ও ইসরাইলের কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চেয়েছি।’
কাতার-ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরার একজন মুখপাত্র জানান, তাদের একজন ফটোসাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান মোহাম্মদ সালামাও এই হামলায় নিহত হয়েছেন।
আল জাজিরা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর এই জঘন্য অপরাধের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে, যারা সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্য একটি পরিকল্পিত অভিযানের অংশ হিসেবে সরাসরি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করেছে।’
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ৩৩ বছর বয়সী ভিজ্যুয়াল সাংবাদিক মরিয়ম দাগার মৃত্যুর খবর শুনে ‘স্তম্ভিত ও শোকাহত।’ তিনি যুদ্ধের শুরু থেকে তাদের হয়ে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
এছাড়া, ফিলিস্তিনি জার্নালিস্টস সিন্ডিকেট মোয়াজ আবু তাহা এবং আহমেদ আবু আজিজ নামে আরও দুই সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করেছে।
পরবর্তীতে সোমবার, ইসরাইলি হামলায় হাসান দোহান নামে আরো এক সাংবাদিক (ষষ্ঠ) নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি জার্নালিস্টস সিন্ডিকেট ও নাসের হাসপাতাল খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় এটি ঘটেছে বলে নিশ্চিত করেছে।
গাজায় গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ এবং অনেক এলাকায় প্রবেশের অসুবিধার কারণে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা বা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দেওয়া হতাহতের সংখ্যা ও বিবরণ এএফপি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
হামলার পরপরই এএফপির ধারণ করা ফুটেজে দেখা যায়, আকাশ ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে এবং হাসপাতালটির বাইরের মেঝেতে বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ফিলিস্তিনিরা আহতদের সাহায্য করার জন্য ছুটে আসে। তারা রক্তাক্ত মৃতদেহ এবং বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে যায়। এসময় বিধ্বস্ত ভবনটির ওপর তলায় ঝুলতে থাকা এক মৃতদেহকে লক্ষ্য করে হাসপাতাটির নিচে এক লোককে চিৎকার করতে দেখা যায়।
চিকিৎসাকর্মীর পোশাক ও সাদা কোট পরিহিত একজন নারী আহতদের মধ্যে ছিলেন। পরে তাকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নেয়া হয়। এসময় তার পায়ে ভারী ব্যান্ডেজ এবং পোশাকে রক্ত লেগে ছিল।
নাসের হাসপাতাল গাজা উপত্যকার হাতে গোনা কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মধ্যে একটি, যা এখনো আংশিকভাবে সচল।
দিনের শেষে, খান ইউনিসে নিহত কয়েকজন সাংবাদিকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সাদা কাফনে মোড়ানো মৃতদেহগুলোর ওপর তাদের প্রেস ভেস্ট রাখা ছিল।
মাসরির ভাই মাহমুদ বলেন, ‘আমরা এই পথ থেকে সরে আসব না এবং আমাদের সংবাদ কভারেজ চলতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।’
জাতিসংঘ, বিভিন্ন গণমাধ্যম, অধিকার গোষ্ঠী এবং ইসরাইল-ভিত্তিক ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন মহল এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে গাজার আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে ইসরাইলি বিমান হামলায় আল জাজিরার চারজন কর্মী এবং দুইজন ফ্রিল্যান্সার নিহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাটিও ব্যাপক নিন্দার জন্ম দেয়।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী দাবি করে যে এই হামলায় নিহত আল জাজিরার একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ হামাসের ‘সন্ত্রাসী সেলের’ প্রধান ছিলেন এবং ইসরাইলের ওপর রকেট হামলা চালানোর জন্য দায়ী ছিলেন।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইলের ওপর হামাসের হামলার পর গাজার এই যুদ্ধ শুরু হয়। এএফপির হিসাব অনুযায়ী, সেই হামলায় ১ হাজার ২১৯ জন ইসরাইলি নিহত হন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
অন্যদিকে, হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলের পাল্টা হামলায় অন্তত ৬২ হাজার ৭৪৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘ এই সংখ্যাকে নির্ভরযোগ্য মনে করে।