শিরোনাম
ঢাকা, ১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া অতিরিক্ত স্লিম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ভুয়া, ভুল ও বিপজ্জনক খাদ্য পরামর্শ তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাসজনিত বিকারে (ইটিং ডিজঅর্ডার) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
প্যারিস থেকে এএফপি জানায়, অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া ও বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডারের মতো সমস্যাগুলোতে তরুণী ও কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেও পুরুষদের মধ্যেও এসব ব্যাধির হার বাড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে বিশ্বে মানুষদের মধ্যে জীবনে কখনো না কখনো খাওয়ার অভ্যাসজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল ৩.৫ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৮ শতাংশে—এই সময়কালেই সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান ঘটে।
এই ব্যাধি থেকে তরুণদের সুস্থ করে তুলতে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে প্রভাবশালীরা খাদ্য সম্পর্কিত যেসব ভুল ও বিভ্রান্তিকর পরামর্শ দেন, তা চিকিৎসায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ফরাসি ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ ক্যারল কোপ্তি বলেন, 'আমরা এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বিশ্লেষণ ছাড়া আর কোনো ইটিং ডিজঅর্ডার চিকিৎসা করি না।'
'সোশ্যাল মিডিয়া এখন একদিকে ট্রিগার, আবার ত্বরান্বিতকারী ও আরোগ্যের প্রতিবন্ধক—সব একসাথে,' তিনি বলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ব্যাধির কারণ জটিল—মনস্তাত্ত্বিক, জিনগত, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক সব ধরনের কারণই ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় 'চূড়ান্ত ধাক্কা' হিসেবে কাজ করে, বলে জানান, ফরাসি স্টুডেন্ট হেলথ ফাউন্ডেশনের শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নাটালি গোদার।
তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া রোগা শরীর, কঠোর ডায়েট ও ক্লান্তিকর ব্যায়ামকে প্রশ্রয় দিয়ে দুর্বল তরুণদের আরও ভেঙে দেয় এবং তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
‘একটি দুষ্টচক্র’
সম্প্রতি #স্কিনিটক নামে একটি টিকটক হ্যাশট্যাগ-এ ভয়ানক ও অপরাধবোধ সৃষ্টিকারী খাদ্য পরামর্শ ছড়িয়েছে, যেখানে খাদ্যগ্রহণ চরমভাবে কমিয়ে দেওয়ার উৎসাহ দেওয়া হয়।
চারলিন বুইগ, যিনি ফ্রান্সে ইটিং ডিজঅর্ডার নিয়ে কাজ করেন, বলেন—সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের জন্য এইসব ব্যাধিকে 'সাধারণ' করে তোলার একটি প্রবেশদ্বার।
তিনি বলেন, 'কোনো কোনো ভিডিওতে দেখা যায়, অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত তরুণীরা অপুষ্ট শরীর প্রদর্শন করছে বা বুলিমিয়ায় ভুগছেন এমনরা নিজেদের ‘পার্জ’ বা বমি করার পদ্ধতি দেখাচ্ছেন।'
বুইগ বলেন, 'ল্যাক্সেটিভ খাওয়া বা ইচ্ছাকৃত বমি করা ওজন কমানোর বৈধ উপায় হিসেবে তুলে ধরা হয়, অথচ এতে হৃদরোগের ঝুঁকি ভয়ানকভাবে বেড়ে যায়।'
খাওয়ার অভ্যাসজনিত বিকার হৃদযন্ত্রের ক্ষতি, বন্ধ্যাত্বসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে, এমনকি আত্মহত্যাপ্রবণতার সঙ্গেও এসব ব্যাধির সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের মনোরোগের মধ্যে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি অ্যানোরেক্সিয়ায়। ফ্রান্সের স্বাস্থ্য বিমা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের অকাল মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে খাওয়ার অভ্যাসজনিত মানসিক ব্যাধি।
ক্যারল কোপ্তি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া এই ব্যাধির ক্ষেত্রে একটি 'দুষ্টচক্র' তৈরি করে।
তিনি বলেন, 'যারা এই রোগে ভোগেন, তাদের আত্মমর্যাদা খুবই কম থাকে। কিন্তু যখন কেউ নিজের অ্যানোরেক্সিয়া-জনিত রোগা শরীর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন, তখন তিনি ফলোয়ার, লাইক ও ভিউ পান—এতে তাদের সমস্যা জিইয়ে থাকে এবং তারা বাস্তবতা অস্বীকার করতেই থাকেন।'
এটি আরও ভয়ানক হয় যখন এর পেছনে অর্থনৈতিক লাভ থাকে।
বুইগ এক তরুণীর কথা বলেন, যিনি নিয়মিত টিকটকে নিজেকে বমি করতে দেখান এবং জানিয়েছেন যে, তিনি এই ভিডিওর মাধ্যমে অর্থ পান—যা দিয়ে তিনি খাবার কেনেন।
‘সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত’
সোশ্যাল মিডিয়া কেবল রোগ বাড়ায় না, রোগ থেকে সেরে ওঠাও করে আরও কঠিন ও দীর্ঘসূত্রতা।
তরুণেরা অনলাইনে পাওয়া ভ্রান্ত ও ভুল খাদ্য পরামর্শ বিশ্বাস করে ফেলে, এতে চিকিৎসা ব্যাহত হয় বলে মনে করেন কোপ্তি।
তিনি বলেন, 'অনেক সময় আমার কনসালটেশনে মনে হয় যেন আদালতে লড়ছি। আমি বারবার বোঝাতে বাধ্য হই—না, দৈনিক ১,০০০ ক্যালোরি খেয়ে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, বা না, নিয়মিত খাবার না খাওয়া স্বাভাবিক নয়।'
'রোগীরা পুরোপুরি প্রভাবিত হয়ে পড়ে—আর আমার ৪৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সেশন টিকটকের ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যবহারের কাছে পরাজিত হয়,' তিনি বলেন।
নাটালি গোদার সতর্ক করেন, অনলাইনে ছদ্মপরামর্শদাতা বা “ছদ্ম-কোচ” নামধারীরা বহু ভুল ও হাস্যকর, এমনকি অবৈধ খাদ্য পরামর্শ ছড়িয়ে দেন।
তিনি বলেন, 'এই প্রভাবশালীদের কথাই মানুষ বেশি গুরুত্ব দেয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। আমরা সবসময় সাধারণ পুষ্টির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে থাকি।'
চিকিৎসক বুইগ বলেন, তিনি প্রায়ই ইনস্টাগ্রামে ক্ষতিকর কনটেন্ট রিপোর্ট করেন, কিন্তু 'এর কোনো ফল হয় না।'
'এইসব কনটেন্ট অনলাইনে থেকেই যায়, খুব কমই অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়—এটা খুবই ক্লান্তিকর,' তিনি বলেন।
অনেক সময় তিনি রোগীদের টিকটক অ্যাপ মুছে ফেলার পরামর্শ দেন।
বুইগ বলেন, 'হয়তো কঠোর শোনাবে, কিন্তু তরুণরা যতদিন না আরও সচেতন হবে, ততদিন এই অ্যাপটা খুবই বিপজ্জনক।'