বাসস
  ০১ জুন ২০২৫, ১২:২৪

ফুকুশিমায় সজীবতার ছোঁয়া : কিউইচাষ করছেন জেন-জি কৃষক

ঢাকা, ১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের স্থান থেকে অল্প দূরে গ্রীষ্মের খর রোদে কিউই গাছের চারা আগলে রাখছেন তরুণ কৃষক তাকুয়া হারাগুচি-একদা ‘নো-গো জোন’ হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে ফিরিয়ে আনছেন সজীবতা, ফল-ফসলের প্রাণবন্ত হাসি।

২০১১ সালের মার্চে জাপানে রেকর্ড সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প ও তৎ-পরবর্তী সুনামিতে প্রায় ১৮,৫০০ মানুষ মারা যান বা নিখোঁজ হন। সেই সুনামির ঢেউ উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আঘাত হানে এবং ঘটে যায় ভয়াবহ চুল্লি গলন বিপর্যয়।

তখন তাকুয়া হারাগুচির বয়স ছিল ১১ বছর। ওসাকার বাসিন্দা এই বইপড়া-ভালোবাসা ছেলে ভাবতেন—তেজস্ক্রিয়তা হয়তো পুরো জাপানকে বসবাসের অযোগ্য করে দেবে।

কিন্তু এখন, বয়স ২৫, তিনি বলেন—ফুকুশিমার ভবিষ্যতের প্রতি তার আস্থা রয়েছে। তিনি ওকুমা শহরের নতুন বাসিন্দা।

হারাগুচি এএফপিকে বলেন, ‘সবাই পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা জানে। কিন্তু এই অঞ্চল ও এর পুনরুত্থান সম্পর্কে খুব কম লোকই জানে।’

তামাটে হয়ে যাওয়া মুখে একটি নির্ভরতার ছাপ রেখে তিনি বলেন, 'আমি চাই মানুষ জানুক, ফুকুশিমা এখন কেমন, এখানে এখন কিউই চাষ করা হয়। এ অঞ্চলকে নতুনভাবে চিনুক তারা।’

ফুকুশিমা অঞ্চল একসময় নাশপতি, পীচসহ সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর অনেকেই এখানকার কৃষিপণ্য কিনতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন।

তবে দুর্ঘটনার সাড়ে ১৪ বছর পর, ব্যাপক দূষণ দূরীকরণ ককর্মসূচি (যার মধ্যে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি তুলে ফেলা অন্তর্ভুক্ত) বাস্তবায়নের পর এখন কর্তৃপক্ষ বলছে-ফুকুশিমার খাবার নিরাপদ এবং তেজস্ক্রিয়তার দিক থেকে কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।

গত বছর লন্ডনের হ্যারডস স্টোরে ফুকুশিমার পীচ বিক্রি হয়েছে। জাপানেও অনেকে এখন ইচ্ছে করে এখানকার কৃষকদের সহায়তার জন্য এই অঞ্চল থেকে উৎপাদিত পণ্য কিনছেন।

হারাগুচি বলেন, ‘নিরাপত্তা প্রমাণিত হয়েছে। আর এ জায়গাতেই আমরা এটি করে দেখাতে চাই।’

‘শূন্য থেকে শুরু’

হারাগুচি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন, কিন্তু ফলের চাষাবাদ ছিল তার স্বপ্ন।

২০২১ সালে তিনি প্রথম ওকুমা সফরে যান-এক শিক্ষার্থীভিত্তিক আয়োজনে অংশ নিতে। সেখানে দেখা হয় কিউই চাষ ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত কিছু স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে।

এক অভিজ্ঞ কৃষকের সঙ্গেও পরিচয় হয়, যিনি দুর্ঘটনার পর এলাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কিউইর স্বাদ হারাগুচিকে মুগ্ধ করে।

সেই অনুপ্রেরণায় বারবার আসেন গবেষণার কাজে। শেষ পর্যন্ত টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা এক সহকর্মীর সঙ্গে মিলে ‘রি-ফ্রুটস’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেন।

তারা ২.৫ হেক্টর (৬ একর) জমি দেখাশোনা করছেন এবং আগামী বছর প্রথম কিউই ফলানোর আশা করছেন।

হারাগুচির মতে, ‘এই অঞ্চল একবার শূন্যে নেমে যাওয়ায়, এখন সব ধরনের নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর ওকুমার ১১ হাজার বাসিন্দা সবাই নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

ফুকুশিমা জুড়ে কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, প্রায় ৮০,০০০ মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে নিরাপত্তার জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়। সমপরিমাণ মানুষ স্বেচ্ছায় এলাকা ছেড়েছিলেন।

পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরগুলো স্থিতিশীল করা হলেও, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে নিষিক্রয় করতে আরও কয়েক দশক লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে ওকুমার কিছু অংশকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণা করে ফেরত আসার অনুমতি দেওয়া হয়।

সাবেক জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম মানুষ ফিরেছেন, তবে হারাগুচির মতো তরুণ বাইরের লোকজন এসে এখন সেখানে বাড়ি করছেন—সরকারি আবাসন ও ব্যবসায়িক প্রণোদনার সুবিধা নিয়ে।

বর্তমানে ওকুমায় বসবাসকারী আনুমানিক ১,৫০০ জনের মধ্যে ১,০০০ জনই নবাগত। কেউ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছেন, কেউ কৃষিকাজে, কেউ আবার প্রযুক্তি স্টার্টআপে।

তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার ব্যবস্থা

বর্তমানে ওকুমা শহরে ডজনখানেক সেন্সর স্থাপন করা হয়েছে, যা তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরীক্ষণ করছে। এসব সেন্সর বলছে—মাত্রা সরকার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার ভেতরে, তবে পরমাণু কেন্দ্র থেকে দূরের অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা বেশি।

কিছু এলাকা, যেমন-অব্যবহৃত পাহাড়ি অঞ্চল এখনও নিষিদ্ধ।

হারাগুচির খামারে মাটির পরীক্ষায় দেখা গেছে, সামান্য বাড়তি তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে, তবে তা আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত খাদ্য নিরাপত্তা মানের মধ্যেই পড়ে।

সরকারের তথ্যানুসারে, ফুকুশিমার ফলে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা গ্রহণযোগ্য সীমার নিচে।

তবে সতর্কতা দিচ্ছেন ‘মাদারস রেডিয়েশন ল্যাব ফুকুশিমা  তারাচিনে’ নামে একটি নাগরিক বিজ্ঞানভিত্তিক অলাভজনক সংস্থার নেত্রী কাওরি সুজুকি।

তিনি বলেন, ‘কে কী খাবে, তা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। তবে সচেতন হওয়া ভালো, কারণ মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভার হয়ে গেছে।’

তাদের সংগঠন স্বাধীনভাবে মাটি ও খাদ্যের তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করে, যাতে স্থানীয়রা তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আন্তর্জাতিকভাবে নিজের গল্প ও ফুকুশিমার গল্প ছড়িয়ে দিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হারাগুচি।

তিনি বলেন, ‘যারা এই জায়গা ও এর ফসল নিয়ে এখনও উদ্বিগ্ন, তাদের ওপর আমাদের পণ্য চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের কাছেই বিক্রি করতে চাই, যারা বুঝে-আমরা কী করছি।’