বাসস
  ৩১ মে ২০২৫, ২১:০৮

লি জে-মিয়ং : কারখানা থেকে কোরিয়ার কাণ্ডারী?

লি জে-মিয়ং। ফাইল ছবি

ঢাকা, ৩১ মে, ২০২৫ (বাসস) : মামলা, কেলেঙ্কারি, সশস্ত্র সেনা কিংবা ছুরি হাতে হামলাকারী—কোনো কিছুই ঠেকাতে পারেনি লি জে-মিয়ংয়ের যাত্রা; পোশাক কারখানার শ্রমিক থেকে তিনি এখন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

সিউল থেকে এএফপি জানায়, ২০২২ সালের নির্বাচনে অতি সামান্য ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর ডেমোক্রেটিক পার্টির এই প্রার্থী আবারও ভোটের মাঠে ফিরেছেন এবং এখন তিনি প্রস্তুত, সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রতিস্থাপন করতে, যার অপসারণে তারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

৬০ বছর বয়সী লি’র জনতুষ্টিকর রাজনীতিকে তার বিরোধীরা সমালোচনা করেন। কিন্তু তার ‘ছেঁড়া জুতা থেকে শীর্ষ পদ’ পর্যন্ত উঠে আসার ব্যক্তিগত গল্প দক্ষিণ কোরিয়ার বহু রাজনৈতিক অভিজাত থেকে তাকে আলাদা করে তোলে।

পরিবারকে সহায়তা করতে স্কুল ছেড়ে কারখানায় কাজ শুরু করেন লি। এক শিল্প দুর্ঘটনায় তার কনুই মারাত্মকভাবে জখম হয়। পরে আইন পড়ার জন্য স্কলারশিপ পান এবং আইনজীবী হিসেবে বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এই জীবনের গল্পকে লি কাজে লাগিয়েছেন একটি শক্তিশালী ও নিবেদিত সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে এবং নিজেকে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কষ্ট বোঝেন- এমন একজন হিসেবে উপস্থাপন করতে।

২০২২ সালে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লি বলেন, ‘তুমি তোমার উষ্ণ লিভিংরুমে বসে বাইরে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা মানুষদের নিয়ে চিন্তা করতে পারো। কিন্তু তুমি কখনোই তাদের কষ্ট সত্যিকারের অর্থে বুঝতে পারবে না।’

সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, পিপল পাওয়ার পার্টির রক্ষণশীল প্রার্থী কিম মুন-সুর সঙ্গে লি’র ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে, কিছু জরিপে এ ব্যবধান এক অঙ্কে নেমে এসেছে। তবুও গত ডিসেম্বরের সামরিক আইন জারির ঘোষণার জেরে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়েওলের অভিশংসনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই লি নেতৃত্বে আছেন।

আইনপ্রণেতারা যখন প্রেসিডেন্ট ইউনকে সামরিক বাহিনী দিয়ে পার্লামেন্ট দখলের কারণে বরখাস্ত করেন, তখন থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হয়।

ঘটনার পরের সেই নাটকীয় মুহূর্তে, লি নিজেই পার্লামেন্ট চত্বরের প্রাচীর বেয়ে উঠে এবং অন্যান্য আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে মিলে সামরিক আইন খারিজে ভোট দিতে ছুটে যান- সবকিছুই তিনি সরাসরি সম্প্রচার করেন। এএফপিকে লি বলেন, ‘এটা ছিল সময়ের বিরুদ্ধে এক দৌড়।’

লি আগে সিউলের দক্ষিণে অবস্থিত সিউংনাম শহরের মেয়র ছিলেন আট বছর। সে সময় তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় কুকুর মাংস বাজারটি বন্ধ করে দেন—যেখানে আগে বছরে প্রায় ৮০,০০০ কুকুর কেনাবেচা হতো।

পরে তিনি রাজধানী ঘিরে থাকা এবং দেশের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা গিয়ংগি প্রদেশের গভর্নর হিসেবে তিন বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি কোরিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ক্ষুদ্র ব্যবধানে হেরে যান ইউনের কাছে।

২০২৪ সালে লি একটি নির্বাচনী অনুষ্ঠানে এক ছদ্ম-সমর্থকের হাতে ছুরিকাঘাতে গলায় আহত হন এবং তাকে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে সেই হামলাকারী স্বীকার করে, লিকে হত্যা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য, যাতে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে না পারেন।

আগামী সপ্তাহে নির্বাচিত হলে লি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—দক্ষিণ কোরিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শীর্ষ তিনে পৌঁছে দিতে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।

তার প্রতিশ্রুতির তালিকায় আরও রয়েছে- সামরিক আইন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা। তাঁর ভাষায়, ‘বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

রাজনীতির শুরুতে লি তার প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। তবে ৩৪ বছরের বৈবাহিক সঙ্গী কিম হে-কিয়ং, যার সঙ্গে লি’র দুটি সন্তান রয়েছে, বলেন—লি ‘চিন্তাভাবনা করে’ কথা বলেন।

২০১৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তিনি প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন, একেবারে নিচু তলা থেকে। যেমন একটি পিসু নিজেকে দৃশ্যমান করতে লাফ দেয়, তেমনই লিকেও লাফ দিতে হয়েছে। আমি আশা করি মানুষ তাকে সেই প্রেক্ষাপটে বুঝবে।’

লি নিজেও একাধিক আইনি জটিলতার সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে- একটি রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এবং নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের আওতায় মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মামলা। তবে লি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে, সিউলের সুপ্রিম কোর্ট একটি নিম্ন আদালতের খালাসাদেশ বাতিল করে এবং মামলাটির পুনরায় বিচার করতে নির্দেশ দেয়। তবে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায়, সিউল হাই কোর্ট ওই পুনর্বিচার পিছিয়ে দেয় আগামী ৩ জুনের ভোটের পর পর্যন্ত।

লি নির্বাচিত হলে, আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দায়মুক্তির কারণে মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে এবং ২০৩০ সালে তাঁর পাঁচ বছরের একক মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবার শুরু হবে। 

লি’র প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলছেন, এত গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তার নির্বাচনে দাঁড়ানোরই কথা নয়।

শুক্রবার এক টেলিভিশন বিতর্কে আগামী সপ্তাহের নির্বাচনে লি’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিম মুন-সু বলেছেন, ‘এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আপনি কীভাবে জনসেবার পদে দাঁড়ান?