বাসস
  ২৯ মে ২০২৫, ১১:৪২
আপডেট : ২৯ মে ২০২৫, ১৩:৪৮

আফ্রিকান সাহিত্যের কিংবদন্তি এনগুগি ওয়া থিওংও আর নেই

আফ্রিকান সাহিত্যের কিংবদন্তি কেনীয় লেখক এনগুগি ওয়া থিওংও। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ২৯ মে, ২০২৯ (বাসস) : আফ্রিকান সাহিত্যের কিংবদন্তি কেনীয় লেখক এনগুগি ওয়া থিওংও ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ছিলেন আদিবাসী আফ্রিকান ভাষায় সাহিত্যচর্চা করা বিরল লেখকদের একজন। এনগুগি কেনিয়ার স্বৈরশাসক ড্যানিয়েল আরাপ মোই-এর শাসনামলে সেন্সরশিপ, কারাবরণ ও নির্বাসনের শিকার হন।

দ্য গার্ডিয়ান বুধবার জানায়, তাঁর মেয়ে ওয়ানজিকু ওয়া থিওংও ফেসবুকে লিখেছেন, 'ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি, আজ বুধবার সকালে আমাদের বাবা এনগুগি ওয়া থিওংও প্রয়াত হয়েছেন।... তিনি পূর্ণ এক জীবন যাপন করেছেন, দারুণ এক লড়াই লড়েছেন।'
তাঁর ছেলে মুকোমা ওয়া থিওংও এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, 'আমি আজ যেটুকু—একজন সন্তান, একজন গবেষক, একজন লেখক—তার পেছনে তাঁরই অবদান।...আমি তাঁকে ভালোবাসি—তিনি ছাড়া আগামীকাল কেমন হবে, বুঝতে পারছি না। আপাতত এটুকুই বলার আছে।'

উপনিবেশবাদের জটিল উত্তরাধিকার নিয়ে প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাস লিখেছেন এনগুগি—তার মধ্যে রয়েছে উইপ নট, চাইল্ড (১৯৬৪), ডেভিল অন দ্য ক্রস (১৯৮০) ও উইজার্ড অব দ্য ক্রো (২০০৬)।

আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যজগতের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত এনগুগি বহু বছর ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অন্যতম সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। ২০১০ সালে পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর এনগুগি বলেছিলেন—পুরস্কার না পাওয়ায় তিনি নিজে যতটা না হতাশ, তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়েছিল তাঁর বাড়ির বাইরে অপেক্ষারত আলোকচিত্রীরা: 'আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়েছিলাম!'

এনগুগি ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন কেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ২৮ ভাইবোনের একজন—তাঁর বাবার ছিল চার স্ত্রী। কৈশোরে তিনি মাউ মাউ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন—যেখানে ব্রিটিশ প্রশাসন লক্ষাধিক মানুষকে বন্দি, নির্যাতন ও হত্যা করে। এই সংঘাতের সময় তাঁর বাবা— গিকুয়ু জনগোষ্ঠীর  সদস্য—নিজের জমি হারান, এবং তাঁর দুই ভাই নিহত হন।

এই ইতিহাসই তাঁকে প্রথম খ্যাতি এনে দেওয়া উপন্যাস উইপ নট, চাইল্ডের পটভূমি। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে শিক্ষার্থী এনজোরজের গল্প বলা হয়েছে—যিনি তার পরিবারের প্রথম স্কুলে যাওয়া সদস্য—এবং যার জীবন চারপাশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তছনছ হয়ে যায়।

এরপর তিনি নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি যুক্তি দেন যে ইংরেজি বিভাগটির নাম পরিবর্তন করে সেটিকে বৈশ্বিক সাহিত্যের প্রতি মনোনিবেশ করানো উচিত।

এক প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'যদি একটি সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনীয়তা থাকে, তবে সেটি আফ্রিকান সংস্কৃতি হতে পারবে না কেন? কেন আফ্রিকান সাহিত্যকে কেন্দ্র ধরে অন্য সংস্কৃতিগুলেকে পর্যালোচনা করা যাবে না?'

১৯৭৭ সালে তিনি তাঁর চতুর্থ উপন্যাস পেটালস অব ব্লাড এবং নাটক দ্য ট্রায়াল অব কিমাথি প্রকাশ করেন—যেখানে মাউ মাউ বিদ্রোহের উত্তরাধিকার তুলে ধরা হয়। তবে গিকুয়ু ভাষায় লেখা নাটক আই উইল মেরি হোয়েন আই ওয়ান্ট তাঁর কারাবরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সহলেখক হিসেবে রচনা করা এই নাটকের জন্য তাঁকে ‘মামিতি’ কারাগারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা শাখায় বন্দি করে রাখা হয়।

২০০৬ সালে তিনি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, 'কারাগারে থাকাকালে আমি ভাষা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করি,...আমি আগে ইংরেজিতে লিখলেও কেন কখনও গ্রেপ্তার হইনি?' সেই থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন—শুধু নিজের ভাষা, গিকুয়ুতেই লিখবেন।

১৯৭৮ সালে মুক্তি পেলেও ১৯৮২ সালে তাঁকে নির্বাসনে যেতে হয়, যখন তিনি জানতে পারেন—ব্রিটেন সফর শেষে দেশে ফিরলে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। তখন তিনি কাইতানি মুথারাবাইনি (ইংরেজি অনুবাদ: ডেভিল অন দ্য ক্রস) উপন্যাসটি প্রচার করছিলেন।

পরে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক লেখালেখি ও অনুবাদ কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

নিজ দেশ কেনিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জটিল হলেও এনগুগি গিকুয়ু ভাষায় লেখালেখি অব্যাহত রাখেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস মাতিগারি'র কাল্পনিক মূল চরিত্রের নামে কেনিয়া সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।

২০০৪ সালে, ড্যানিয়েল আরাপ মোই-এর মৃত্যুর দুই বছর পর, তিনি ও তাঁর স্ত্রী জিঁরি প্রথমবারের মতো কেনিয়া ফেরেন। বিমানবন্দরে তাঁকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সফরের সময় বন্দুকধারীরা তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টে হানা দেয়—জিঁরিকে ধর্ষণ ও এনগুগিকে মারধর করে। দুই বছর পর তিনি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, 'আমার মনে হয়, আমাদের বাঁচার কথা ছিল না।'

২০০৬ সালে ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাস উইজার্ড অব দ্য ক্রো'তে তিনি আফ্রিকান দুঃশাসনের বিষয়টি পুনরায় তুলে আনেন, যেখানে ঘটনাপ্রবাহ ঘটে একটি কাল্পনিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র 'ফ্রি রিপাবলিক অব আবুরিরিয়া'য়। তিনি বলেছিলেন, 'উপন্যাসটির সবচেয়ে সুন্দর বাক্যটি ছিল 'গিকুয়ু থেকে লেখকের অনুবাদ'।'

তিনি নিজের রচনাগুলোর অনুবাদ নিজেই করতেন। ২০২১ সালে মহাকাব্যিক কাব্যোপন্যাস দ্য পারফেক্ট নাইন বইটির জন্য তিনি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের মনোনয়ন পান। এটি ছিল কোনো আদিবাসী আফ্রিকান ভাষায় লেখা প্রথম মনোনীত গ্রন্থ, এবং লেখকের নিজের অনুবাদ করা প্রথম মনোনীত গ্রন্থও।

১৯৯৫ সালে তাঁর প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়ে, আর ২০১৯ সালে তাঁর হৃদযন্ত্রে তিনটি বাইপাস সার্জারি করা হয়।

এনগুগি ওয়া থিওংও ছিলেন নয় সন্তানের জনক, যাদের মধ্যে চারজন লেখক: টি ওয়া থিওং’ও, মুকোমা ওয়া থিওংও, দুঁকু ওয়া থিওংও এবং ওয়ানজিকু ওয়া থিওংও।

২০১৮ সালে দ্য গার্ডিয়ান-কে তিনি বলেছিলেন, 'প্রতিরোধই বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়। এটি অবিচারের বিরুদ্ধে ছোট্ট একটা ‘না’ বলার মাধ্যমেও হতে পারে। যদি আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে আপনি সঠিক, তাহলে আপনার বিশ্বাস আঁকড়ে থাকুন—এটাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে।'