বাসস
  ২৯ মে ২০২৫, ১০:৫৮

আসকার শিবিরে ইসরাইলি অভিযানের সরেজমিন বিবরণ

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ২৯ মে, ২০২৫ (বাসস): ২০২৫ সালের মে মাসে ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের উত্তরের আসকার শরণার্থী শিবিরে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালায়। চলমান সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে পরিচালিত এ অভিযানে টিয়ার গ্যাস ও গুলির কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, আহত হন অনেক মানুষ। সাংবাদিক ও স্থানীয়দের জন্য পরিস্থিতি ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

ফিলিস্তিনের নাবলুস থেকে এএফপির প্রতিনিধি হুয়াং জেমিন ও ফেং গুওরুই জানান, মে মাসের এক সকালে এই সতর্কবাণী ছড়িয়ে পড়ে—জরুরি, অবধারিত। লক্ষ্য: নাবলুস শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত আসকার শরণার্থী শিবির। আমরা দেরি করিনি। দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

শুরু থেকেই এটি ছিল অনিশ্চয়তায় ঘেরা এক যাত্রা। ইসরাইলি বাহিনীর পরিকল্পনা সাধারণত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের জানানো হয় না। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। অনেক সময় অভিযানের সময় শিবিরের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কখনও আবার সাংবাদিকেরা পৌঁছার আগেই অভিযান শেষ হয়ে যায়।

সে সকালেই দেখা যায়, ইসরাইলি সামরিক যান আসকার শিবিরের প্রান্তবর্তী একটি লেন বন্ধ করে রেখেছে। উদ্দেশ্য—যাতায়াত ব্যাহত করা ও সংবাদকর্মীদের বাধা দেওয়া। সাংবাদিকদের শিবিরের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়, ভিতরে কী ঘটছে, তা তখনও অজানা। একাধিকবার ইসরাইলি গাড়ি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে—অনেকের মতে, সংবাদকর্মীদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে।

সেখানে তখনও শান্তি বিরাজ করছিল, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ শুরু হতে পারত। অনেক সময় তরুণ ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি গাড়িতে পাথর নিক্ষেপ করে কিংবা টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিরোধ দেখায়। জবাবে ইসরাইলি বাহিনী গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপরই এলোমেলো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়—চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ভয়।

এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সতর্কতা ও সুরক্ষাসামগ্রী ছিল আবশ্যক। আমাদের কাছে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, হেলমেট ও গ্যাস মাস্ক ছিল। সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য প্রফেশনাল ক্যামেরা বহন করা হয়—এটা সংঘর্ষরত পক্ষগুলোর কাছে একটি দৃশ্যমান সংকেত।

সেই সকালেই স্থানীয় ফটোসাংবাদিক মাজদি মোহাম্মদ বলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনি-ইসরাইলি সংঘর্ষ নতুন করে জোরালো হয়ে ওঠার পর পশ্চিম তীরে সাংবাদিকতা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। 'প্রেস' লেখা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরেও তিনি গুলি ও টিয়ার গ্যাসে বহুবার আহত হয়েছেন বলে জানান।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই পশ্চিম তীরেও সহিংসতা তীব্র হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী উত্তর পশ্চিম তীরে বড় পরিসরে সামরিক অভিযান শুরু করে, যা এখনো চলছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই অভিযানে প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

যদিও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেনিন ও তুলকারেম গভর্নরেট, তবে নাবলুসও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১ জানুয়ারি থেকে চলমান অভিযানে এ পর্যন্ত সারা পশ্চিম তীরে ১,০৫৮ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন, যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি নাবলুস গভর্নরেটেই।

সেই সকালে আসকার শিবিরের পাশে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রস্তুত অবস্থায় ছিল। মেডিকেল কর্মীরা জানান, ইসরাইলি বাহিনী শিবিরের কিছু বাড়ি চিহ্নিত করছিল, যার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়।

সাংবাদিকেরা ধীরে ধীরে শিবিরের প্রান্ত বরাবর এগিয়ে যান, প্রবেশপথের কাছে ভিডিও ধারণ শুরু করেন। তখনই উত্তেজনা বেড়ে যায়—ইসরাইলি সেনারা অস্ত্র হাতে একটি গাড়ি থেকে নামার পর লোকজন দিগ্বিদিক ছুটে পালিয়ে যায়। সেনারা একাধিক দিক থেকে শিবিরে ঢুকে পড়ে।

অভিযানের শেষ এক ঘণ্টায় একাধিক বিকট শব্দ শোনা যায়—সম্ভবত গুলির শব্দ। ইসরাইলি বাহিনী শিবিরসংলগ্ন রাস্তার বিভিন্ন স্থানে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। মুহূর্তেই ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় এলাকা। স্থানীয়রা নাক-মুখ ঢেকে দ্রুত আশ্রয় নেয় বাড়ি বা গাড়ির ভেতরে। অনেকে প্রচণ্ড কাশিতে ভেঙে পড়ে।

পুরো অভিযান চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। ইসরাইলি সেনাবাহিনী এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। ইসরাইলি পুলিশ জানায়, সেদিন নাবলুসের কাছে একজন ‘চিহ্নিত ব্যক্তি’কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট স্থান উল্লেখ করেনি।

ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানায়, সেদিন আসকার শিবিরে অভিযানকালে ইসরাইলি বাহিনীর ছোড়া টিয়ার গ্যাসে বহু মানুষ শ্বাসরোধজনিত সমস্যায় ভোগে।