শিরোনাম
ঢাকা, ২৫ মে, ২০২৫ (বাসস) : যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আজ রোববার স্মরণ করা হচ্ছে জর্জ ফ্লয়েডকে। পাঁচ বছর আগে মিনিয়াপলিসে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছিলেন এই কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। তবে এই দিবসটি শুধু এক ব্যক্তির স্মরণ নয়, বরং একটি প্রতীকী মুহূর্ত—যা গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। একই সঙ্গে আজকের বাস্তবতা বলছে, সেই ক্ষণিক জাগরণ এখন বিস্মৃতি ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে।
মিনিয়াপলিস থেকে এএফপি জানায়, ২০২০ সালের ২৫ মে মিনিয়াপলিসের একটি সড়কে ফ্লয়েডের ঘাড়ে নয় মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। সেই ঘটনার ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে, উসকে দেয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম)’ আন্দোলনের বিশাল ঢেউ।
যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরে মানুষ তখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ, কাঠামোগত বৈষম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে সেই আন্দোলন হয়ে ওঠে এক যুগান্তকারী সামাজিক শক্তি।
কিন্তু পাঁচ বছর পর, সেই আন্দোলনের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যেসব সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অনেকটাই বাতিল করে দিয়েছেন পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথ গ্রহণের পর তার প্রশাসন নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, এবং কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত নীতিমালা বাতিল করেছে।
অন্যদিকে, পাঁচ বছর আগের জনসমর্থন এখন অনেকটাই স্তিমিত। আন্দোলনের সময় যেসব শহরে বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল, সেগুলোর উদাহরণ দেখিয়ে এখন অনেকে বলছেন— বিএলএম বাস্তব পরিবর্তনের চেয়ে বিভাজনই বেশি তৈরি করেছে।
ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনও অনেক বিশ্লেষকের মতে, ছিল একধরনের প্রতিক্রিয়া—তৎকালীন প্রতিবাদ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর।
জর্জ ফ্লয়েড স্কয়ার: স্মৃতি ও প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু
ফ্লয়েড যেখানে নিহত হয়েছিলেন, মিনিয়াপলিসের সেই ছোট্ট মোড়টি এখন পরিচিত ‘জর্জ ফ্লয়েড স্কয়ার’ নামে। একটি আবাসিক এলাকার সংযোগস্থলে অবস্থিত এই জায়গাটি আজও প্রতিবাদের চিহ্ন বহন করে চলেছে। দেয়ালে আঁকা রয়েছে বেগুনি রঙের একটি দেয়ালচিত্র—‘তুমি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছো, জর্জ’।
পাঁচ বছর আগে আঁকা এই আশাবাদী বার্তাটি আজ যেন কিছুটা বেমানান, কারণ আজকের যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায়, যার ঘনিষ্ঠজনরা পর্যন্ত খুনি শভিনের ক্ষমার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে ফ্লয়েডের পরিবারের সদস্যরা এই রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রতিরোধের মাধ্যমে মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফ্লয়েডের খালা অ্যাঞ্জেলা হ্যারেলসন বলেন, 'কালো মানুষের জীবন যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বলার জন্য কোনো নির্বাহী আদেশ দরকার নেই আমাদের। ট্রাম্প যদি সেটা না বোঝেন, তবে আমরা বুঝিয়ে দেব।' তিনি একটি কালো টি-শার্ট পরেছিলেন, যাতে ফ্লয়েডের মুখমণ্ডল আঁকা।
ফ্লয়েডের চাচাতো বোন প্যারিস স্টিভেন্স আরও বলেন, 'আজ আর কেউ আমাদের থামাতে পারবে না।'
স্মরণ ও সম্মান: ব্যক্তিগত শোক থেকে জাতীয় প্রশ্নে উত্তরণ
শুক্রবার বিকেলে ফ্লয়েডের পরিবার ও সমর্থকরা মিলিত হন সেই সড়কপথে, যেখানে ফ্লয়েডের শেষ মুহূর্তগুলো ধারণ করা হয়েছিল মোবাইল ক্যামেরায়। তারা নীরবতা পালন করেন এবং সেখানে হলুদ গোলাপ রাখেন— এক প্রতীকী শ্রদ্ধার্ঘ্য।
রোববার রাতে মোমবাতি প্রজ্বালনের আয়োজনসহ পুরো সপ্তাহান্তজুড়ে চলেছে সংগীত, শিল্প, এবং নৃত্যানুষ্ঠান— স্মরণ, শোক ও সংহতির এক মিশ্র আয়োজন।
এবারের বার্ষিক স্মরণ আয়োজনের মূল স্লোগান— ‘দ্য পিপল হ্যাভ স্পোকেন’, যা প্রস্তাব করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি। আয়োজকদের মতে, এ শিরোনাম পাঁচ বছরের প্রতিবাদের ধৈর্য এবং প্রত্যয়কেই তুলে ধরে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও চিকিৎসক জিল ফস্টার বলেন, 'ট্রাম্প প্রশাসন ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে চায়। কিন্তু আমরা ইতিহাস ভুলতে দেব না। আমরা স্মৃতি রক্ষা করব, তথ্য প্রচার করব।'
ব্যক্তিগত ব্যথা, জাতিগত প্রতিরোধ
ফ্লয়েডের তৎকালীন প্রেমিকা কোর্টনি রস বলেন, 'আমি তাকে প্রতিদিন মিস করি। তবে আজ তাকে স্মরণ করতে মানুষের একত্রিত হওয়া— এটা অসাধারণ। এখনকার আমেরিকায় একতার এত অভাব, কিন্তু আজ আমরা দেখছি যে মানুষ এক হয়েছেন এক আত্মদানের সম্মানে।'
তিনি আরও বলেন, 'একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবন দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন— আজ তাকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।'
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বর্ণবৈষম্যের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। পাঁচ বছর পর আজ সেই প্রশ্ন আবারও প্রাসঙ্গিক, এবং উত্তরের পথ খুঁজে নিতে চায় দেশটির অনেক নাগরিক।