শিরোনাম
ঢাকা, ২১ মে, ২০২৫ (বাসস) : আর্কটিকের সাদা বরফে পড়ে আছে এক বিশালাকৃতির মেরু ভাল্লুক। কিছুক্ষণ আগেই হেলিকপ্টার থেকে শ্বেতশুভ্র প্রাণীটিকে গুলি ছোড়া হয়েছিল, তবে সেটি ছিল চেতনানাশক ডার্ট।
বিশাল এই শিকারের শরীরে ডার্ট লাগতেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে তুষার চাদরের ওপর।
এই রোমাঞ্চকর দৃশ্যটি ছিল নরওয়ের স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জে পরিচালিত এক ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা অভিযানের অংশ। সেখানে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মেরু ভাল্লুকের চর্বি টিস্যু (বায়োপসি) সংগ্রহ করেছেন। তাদের লক্ষ্য পরিবেশ দূষণ প্রাণীটির স্বাস্থ্যে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, তা খুঁজে বের করা।
গবেষণাটি এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন আর্কটিক অঞ্চলটি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে চারগুণ দ্রুত হারে উষ্ণ হচ্ছে।
এর ফলে সমুদ্র-বরফ হ্রাস পেয়ে মেরু ভাল্লুকের আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়ছে।
"আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গবেষণাগারে বসেই যতটা সম্ভব নির্ভুলভাবে এই ভল্লুকদের প্রকৃত পরিবেশের প্রতিক্রিয়া বোঝা," বলেন বেলজিয়ামের বিষবিজ্ঞানী ও গবেষক পিরার্ড।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "আমরা পাতলা টুকরো করে কেটে তাদের শরীর থেকে চর্বি সংগ্রহ করি। তারপর সেই টিস্যুগুলোতে দূষণকারী পদার্থ ও স্ট্রেস হরমোন প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করি।"
গবেষণার পদ্ধতি: নমুনা ভাল্লুকটি অজ্ঞান হয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। তখন গবেষক দল তাড়াতাড়ি নেমে পড়েন। একজন ভল্লুকের দেহ থেকে চর্বির নমুনা কাটেন, আরেকজন রক্ত সংগ্রহ করেন। এরপর প্রতিটি নমুনা লেবেল করে সংরক্ষণ করা হয়। আর ভাল্লুকটির গলায় পড়িয়ে দেওয়া হয় স্যাটেলাইট কলার।
গবেষকেরা জানান, সব ভাল্লুককে পর্যবেক্ষণে রাখলেও শুধু মাদী ভাল্লুকদের গলায় জিপিএস কলার বসানো যায়, কারণ, তাদের ঘাড় মাথার চেয়ে সরু। আর পুরুষ ভাল্লুকদের ক্ষেত্রে কলার খুলে যায়।
আর্কটিকের গবেষণাগার: নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউটের গবেষণা জাহাজ ‘ক্রোনপ্রিন্স হোকন’-এ থাকা বিজ্ঞানীদের জন্য ভাল্লুকগুলোর সঙ্গে হওয়া এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ ছিল বহু মাসের প্রস্তুতি ও বহু বছরের আর্কটিক গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ।
জাহাজটির অস্থায়ী পরীক্ষাগারে ভল্লুকদের শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনাগুলো কয়েকদিন পর্যন্ত পরীক্ষার উপযোগী রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে এগুলোতে পরিমিত পরিমাণে দূষণকারী রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা হয়। এরপর সেগুলো বিশ্লেষণের জন্য জমিয়ে রাখা হয় এবং পরে স্থলভাগে নিয়ে যাওয়া হয় আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্য।
কী পাওয়া গেছে গবেষণায়: চর্বির নমুনায় মূলত পাওয়া গেছে পিএফএএস নামক রাসায়নিক, এগুলো শিল্প ও ভোক্তা পণ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং পরিবেশে বহু বছর ধরে টিকে থাকে।
তবে আশার বিষয় হলো, এত বছরের দূষণের সত্ত্বেও স্বালবার্ডের মেরু ভাল্লুকদের মধ্যে দুর্বলতা বা অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়নি। এখানকার স্থানীয় ভাল্লুকের সংখ্যা স্থিতিশীল রয়েছে, এমনকি কিছুটা বেড়েছে বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বিপরীতে কানাডার পশ্চিম হাডসন উপসাগর অঞ্চলে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভাল্লুকের সংখ্যা ২৭ শতাংশ কমে গেছে (৮৪২ থেকে ৬১৮-তে)। আরেকটি অঞ্চল, দক্ষিণ বেউফোর্ট সী-তেও শিকার সংকট ও বরফহীন দীর্ঘ মৌসুমের কারণে সংখ্যাটা কমছে।
বর্তমানে স্বালবার্ড অঞ্চলে আনুমানিক ৩ শ’ মেরু ভাল্লুক, আর বৃহত্তর উত্তর মেরু-বারেন্টস সাগর জুড়ে প্রায় ২ হাজার ভাল্লুক রয়েছে।
খাদ্যাভ্যাস ও দূষণ:বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বরফ কমে যাওয়ার ফলে মেরু ভল্লুকের খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন হচ্ছে। দুই ধরনের ভাল্লুক স্থলভিত্তিক (সিডেনটারি) এবং সমুদ্রভিত্তিক (প্যালাজিক) ভিন্ন ধরনের খাবার খায়, ফলে তাদের দেহে জমা হওয়া রাসায়নিকও ভিন্ন।
প্রাণীগুলো এখনো সীল মাছ শিকার করে, তবে বরফ কমে যাওয়ায় তারা হরিণ, ডিম, এমনকি ঘাস বা সামুদ্রিক শৈবালও খাচ্ছে, যদিও এগুলোর পুষ্টিগুণ কম।
স্বালবার্ড পোলার বিয়ার প্রোগ্রামের প্রধান জন আয়ার্স বলেন, “বরফ কমে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় স্থলে কাটাচ্ছে।”
এই মৌসুমে গবেষক দল ৫৩টি ভাল্লুক ধরে নমুনা সংগ্রহ করেছেন, এর মধ্যে ১৭টিকে কলার পরানো হয়েছে এবং ১০টি মা ও ছানা ভল্লুককে ট্র্যাক করা হয়েছে।
প্রযুক্তির নতুন সংযোজন: শুধু বায়োপসি নয়, গবেষকরা এবার পাঁচটি মাদী ভল্লুকের গায়ে 'হেলথ লগ' নামক ছোট যন্ত্র স্থাপন করেছেন, যা তাদের হৃৎস্পন্দন ও তাপমাত্রা পরিমাপ করবে। জিপিএস ডেটার সঙ্গে একত্রে এই যন্ত্রটি ভল্লুকদের গতিবিধি ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণে সাহায্য করবে।
১৯৭৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ চুক্তির পর থেকে স্বালবার্ডে মেরু ভাল্লুক শিকার নিষিদ্ধ করা হয়।
তারপর থেকেই এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে।