বাসস
  ১৪ মে ২০২৫, ১২:১৬

গরমে রেকর্ড হারে এসি বিক্রি ভারতে, বাড়ছে বিদ্যুৎ চাহিদা ও কার্বন নির্গমন

ঢাকা, ১৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : ভারতে চলতি বছর গ্রীষ্মের তীব্রতায় বিপর্যস্ত নাগরিকরা আশ্রয় নিচ্ছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি)'র।  অসহ্য গরম থেকে একটুখানি স্বস্তি পেতে এবং প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহ এড়াতে অনেকে শেষ সম্বল খরচ করে বাড়িতে এসি বসাচ্ছেন। তবে এর ফলে দেশটিতে বিদ্যুৎ চাহিদা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি দুই-ই বাড়ছে।

নয়াদিল্লি থেকে এএফপি জানায়, গত বছর ভারতে রেকর্ড ১ কোটি ৪০ লাখ এসি বিক্রি হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে আবাসিক পর্যায়ে এসির মালিকানা নয় গুণ বৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এতে জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত হলেও দেশটির কার্বন নিঃসরণ ও শহরগুলোর উষ্ণতা আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

‘দিন শেষে একটু স্বস্তি চাই’

দিল্লির দরিদ্র এক পাড়ায় বসবাসকারী ২৫ বছর বয়সী বিক্রয়কর্মী আরতি বর্মা মাসে ৩০ হাজার রুপি আয় করেন। এসি কেনা তার জন্য বিলাসিতা হলেও তীব্র গরমে সেটাই এখন ‘অপরিহার্য’, বলছেন তিনি। একটানা দোকানে দোকানে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে যেন রাতে একটু স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেন, সেই আশাতেই ৫০ হাজার রুপি ব্যয় করে এসি বসিয়েছেন তিনি।

'আগে ছাদে ঘুমাতাম। এখন এমন গরম পড়ে যে, রাতেও ঘর ঠান্ডা হয় না,' বললেন আরতি। এসির জন্য তাকে ১৩ হাজার রুপি অগ্রিম দিতে হয়েছে, বাকিটা মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করবেন।

'বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন’

ডাইকিন ইন্ডিয়ার প্রধান কে. জে. জাওয়া বলেন, 'আজকের দিনে এসি আর বিলাসিতা নয়, বরং স্বাস্থ্যকর ঘুম ও কাজের উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে একটি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ।'

বর্তমানে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এসি বাজার। তবে দেশের মাত্র সাত শতাংশ পরিবার এখন পর্যন্ত এসি ব্যবহার করে। বিশাল জনগোষ্ঠী (১৪০ কোটির বেশি) এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিন গুণ বাড়াতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০২৪ সাল ছিল ভারতে রেকর্ড করা ইতিহাসে সবচেয়ে গরম বছর। ওই বছরের মে মাসে দিল্লিতে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৪৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা আগের রেকর্ডের সমান।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গরমজনিত অসুস্থতায় ভারতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১১ হাজার মানুষের। তবে তাপজনিত কারণ অনেক সময় মৃত্যুসনদে উল্লেখ না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

উষ্ণতা বাড়ানোর দুষ্টচক্র

এসি ব্যবহারের কারণে ঘরের ভেতরের গরম বাতাস বাইরে বেরিয়ে আসে, যা শহরের উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘের আবাসন সংস্থা (ইউএন-হ্যাবিট্যাট) বলছে, শহরে এসি ব্যবহারের ফলে আশপাশের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

আলোচিত একটি গবেষণায় বলা হয়, ভবিষ্যতে এসি ব্যবহারের কারণে ভারতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ চাহিদার অর্ধেক এবং দেশের মোট নির্গমনের এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী থাকবে এই একটি খাত।

দূষণ, বিক্রি ও প্রতিরোধের চেষ্টা

দিল্লির ইমপেরিয়াল রেফ্রিজারেশনের মালিক জপসাহিব সিং আহুজা জানান, গত পাঁচ বছরে তাদের এসি বিক্রি তিনগুণ বেড়েছে। তবে দিল্লির দূষণযুক্ত বাতাসের কারণে এসির আয়ুষ্কাল কমে গেছে—দ্রুত গ্যাস লিকেজ ও যন্ত্রাংশ ক্ষয় হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'এখন সবাই ইনভার্টার প্রযুক্তির বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এসির দিকে ঝুঁকছেন। কোম্পানিগুলো ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ডিফল্ট তাপমাত্রা হিসেবে ঠিক করছে।'

জাতিসংঘের ‘কুল কোয়ালিশন’ বলছে, যদিও ভারত এখনো এ খাতে নির্গমন হ্রাসে বৈশ্বিক ‘কুলিং প্লেজ’-এ সই করেনি, তবুও দেশের ভোক্তারা ধীরে ধীরে জ্বালানি দক্ষ এসির দিকে ঝুঁকছেন।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির দ্বৈত চাপে ভারতে এসির ব্যবহার আশীর্বাদ না অভিশাপ—তা এখনই বলা কঠিন। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি ও জ্বালানির উৎস না বদলালে ভবিষ্যতে এর মূল্য হয়তো আরও চড়া হবে।