বাসস
  ০৩ মে ২০২৫, ২৩:১৯

পাকিস্তান সীমান্তবর্তী ভারতের গ্রামে থমকে আছে জীবনযাত্রা

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ৩ মে ২০২৫ (বাসস) : শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কাঁটাতারে ঘেরা সীমান্তে কৃষিপ্রধান গ্রামের বাসিন্দারা তাদের পরিবারকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলেছেন, স্মরণ করছেন দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার সর্বশেষ বড় সংঘর্ষের আতঙ্ক।

যারা এখনও চওড়া চেনাব নদীর তীরে অবস্থিত সেইন্ত গ্রামে আছেন, প্রায় ১,৫০০ জনের এই বসতি, তারা পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মাঝে বিভাজনরেখা পেরিয়ে তাকিয়ে থাকেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়।

গ্রামের নির্বাচিত প্রধান ৬০ বছর বয়সী সুখদেব কুমার বলেন, ‘আমাদের মানুষজন খুব দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারে না।’

তিনি যোগ করেন, ‘এখানে বেশিরভাগ মানুষ বাড়ির বেশি কিছুতে ন্যূনতম একটুখানি বিনিয়োগ করেন না। কারণ কে জানে, কখন ওপার থেকে ভুল নিশানায় ছোড়া কোনো গোলা এসে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে।’

ভারতশাসিত কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো ভয়াবহ এক হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে—এ অভিযোগের পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক দ্রুত অবনতি ঘটেছে।

ভারতীয় পুলিশ পহেলগামে ২২ এপ্রিল সংঘটিত ওই হামলায় জড়িত তিনজনের পোস্টার প্রকাশ করেছে। দুইজন পাকিস্তানি ও একজন ভারতীয়- যারা জাতিসংঘ স্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য বলে দাবি করা হয়েছে।

ইসলামাবাদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর দুই দেশ একে অপরের নাগরিককে বহিষ্কারসহ নানা কূটনৈতিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছে।

ভারতের সেনাবাহিনী শনিবার জানায়, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে রাতভর গুলিবিনিময় হয়েছে—যা ২৪ এপ্রিল থেকে প্রতিদিনই ঘটছে।

‘ভয়ের মধ্যে জীবন’

মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। উভয় দেশই অঞ্চলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে।

সেইন্ত গ্রামটি হিন্দু-অধ্যুষিত ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের অংশ। এখানকার উর্বর খোলা মাঠ আর সবুজে ঘেরা এলাকা জুড়ে ব্যাপক নিরাপত্তা উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রধান সড়কের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেনাশিবির; কাঁটাঝোপের মধ্যে মাথা উঁচু করে রয়েছে ওয়াচটাওয়ার।

কুমার জানান, অধিকাংশ পরিবার বিকল্প হিসেবে অন্য কোথাও বাড়ি বানিয়ে রেখেছে। এখন গ্রামে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জমির মালিক পরিবার রয়েছে। বাকিরা চলে গেছেন।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলও প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সময় পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

৪০ বছর বয়সী স্থানীয় স্কুলশিক্ষক বিক্রম সিং তখন কিশোর ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তখন গোলাবর্ষণের সময় মর্টারের গোলা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেত, কিছু কিছু খুব কাছেই বিস্ফোরিত হতো।’

‘তখন যেমন টানটান উত্তেজনা ছিল, এখনো তেমনই আছে। পহেলগামের হামলার পর থেকে শিশু-বৃদ্ধ সবাই আতঙ্কে আছে,’ বলেন তিনি।

বিশ্বব্যাপী ভারত ও পাকিস্তানকে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশকে ‘উত্তেজনা হ্রাসে’ আহ্বান জানিয়েছে; প্রতিবেশী চীন বলেছে ‘সংযম’ দেখাতে; আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিস্থিতিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।

তবে মাটির বাস্তবতায় সিং যেন যুদ্ধকে অবধারিত বলেই মেনে নিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় আমাদের মনে হয় যুদ্ধ হতেই হবে। কারণ, আমাদের জন্য যুদ্ধ তো প্রতিদিনের বাস্তবতা।”

‘আমরা তো প্রতিনিয়ত গোলাবর্ষণের ঝুঁকির মধ্যে বাস করি। যুদ্ধ হলে অন্তত এক বা দুই দশক হয়তো শান্তিতে থাকতে পারব।”

‘আশ্রয়কেন্দ্র পরীক্ষা করছি’

জম্মুর আরেকটি সীমান্তবর্তী গ্রাম ত্রেওয়ায় ব্যাপক প্রস্তুতির ব্যস্ততা চলছে।

৩৬ বছর বয়সী সাবেক গ্রামপ্রধান বলবীর কৌর বলেন, ‘এখনো পরিস্থিতি শান্ত। সর্বশেষ সীমান্তে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ২০২৩ সালে ঘটেছিল।’

তবে সতর্কতা হিসেবে গ্রামবাসীরা কংক্রিটের আশ্রয়কেন্দ্র পরিষ্কার করে প্রস্তুত করছেন।

তিনি বলেন, ‘আগেও পাকিস্তানের মর্টার শেলের আঘাতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। গত কয়েক দিন ধরে আমরা আমাদের বাঙ্কার পরীক্ষা করছি, মহড়া দিচ্ছি এবং জরুরি প্রস্তুতি পরিকল্পনা ঝালাই করছি।’

তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবস্থানকে সমর্থন করে বলেন, ‘প্রত্যেক সন্ত্রাসী ও তাদের মদদদাতাকে শাস্তি দিতে হবে এবং পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করা হবে,’ এটাই সঠিক অবস্থান।

৬৫ বছর বয়সী কৃষক দ্বারকা দাস সাত সদস্যের পরিবারের প্রধান। তিনি বহু ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ দেখেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা এমন পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত।’

‘আগের সংঘর্ষগুলোতে আমরা স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা আশপাশের শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না।’