বাসস
  ০২ মে ২০২৫, ০৯:৫৩

অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে  তীব্র বিতর্ক

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ২ মে, ২০২৫ (বাসস): সূর্য ও বাতাসের প্রাকৃতিক উৎসে সমৃদ্ধ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ খনিজে পরিপূর্ণ অস্ট্রেলিয়া নিজেকে ‘নেট-জিরো’ কার্বন নির্গমনের পথে অগ্রণী দেশ হিসেবে তুলে ধরছে এবং এ নিয়ে তারা রীতিমতো গর্ব করতে পারে।

সিডনি থেকে এএফপি জানায়, তবে শনিবারের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক চলছে—দেশটির জ্বালানি নীতিতে পরিবর্তন এনে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক চুল্লি (নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর) যুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়ে।

এই বিতর্ক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘জলবায়ু যুদ্ধ’-এর কথা—কার্বন নির্গমন কমানোর প্রয়োজনীয়তা ঘিরে বহু বছর ধরে চলা রাজনৈতিক টানাপড়েন, যেটির অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিন বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ।

বিশ্বের বৃহৎ ইউরেনিয়াম মজুদের অন্যতম দেশ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেখানে গত ২৫ বছর ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন আইনত নিষিদ্ধ।

এখন এই নিষেধাজ্ঞা ভাঙার প্রস্তাব দিয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা পিটার ডাটন। শনিবারের ভোটের আগে তিনি ২০৫০ সালের মধ্যে ৭টি বৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।

এই পরিকল্পনায় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হবে, সৌর ও বায়ু প্রকল্পের সম্প্রসারণ ধীর করা হবে এবং আলবানিজের নেতৃত্বাধীন মধ্য-বাম সরকারের ‘নির্মল জ্বালানি লক্ষ্য’ পরিত্যাগ করা হবে।

ডাটনের দাবি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় সস্তা ও আরও নির্ভরযোগ্য হবে। তিনি এক টেলিভিশন বিতর্কে বলেন, 'ভোটের জন্য নয়, বরং দেশের সর্বোত্তম স্বার্থেই আমি পারমাণবিক জ্বালানির পক্ষে অবস্থান নিয়েছি।'

বিশ্বজুড়েই জ্বালানি নিরাপত্তা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারমাণবিক জ্বালানির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ ৩১টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানির সক্ষমতা তিনগুণ বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।

ধীর ও ব্যয়বহুল

অস্ট্রেলিয়া জীবাশ্ম জ্বালানির শক্তিধর দেশ হলেও এখানকার বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক ভূমি ও প্রচুর রোদ-বাতাস সৌর ও বায়ু প্রকল্পে ব্যবহারের উপযোগী।

দেশটির বিজ্ঞান সংস্থা সিএসআইআরও বলছে, পারমাণবিক বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি ব্যয়বহুল এবং তা চালু হতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'পারমাণবিক প্রযুক্তি বাস্তবায়নে যে দীর্ঘ সময় লাগে, তা বিবেচনায় বিদ্যুৎখাতে নির্গমন হ্রাসে এর কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়।'

এমনকি যেসব দেশ বহু বছর ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভিজ্ঞ, তারাও নির্ধারিত সময় ও বাজেট অনুযায়ী প্রকল্প শেষ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যেমন ফ্রান্সের ফ্লামানভিল-৩ চুল্লিটি চালু হতে ১২ বছর দেরি হয়েছে এবং বাজেট ছাড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন ইউরো।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে নবায়নযোগ্য খাতে বিপুল সরকারি অর্থ ঢালছেন।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ায় ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ বেড়ে রেকর্ড ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

‘অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি’ তৈরি করবে

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের পুরোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন বন্ধ হচ্ছে এবং এগুলোর বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য উৎসই সবচেয়ে যৌক্তিক পথ।

ক্লিন এনার্জি কাউন্সিলের মুখপাত্র ক্রিস ও’কিফ বলেন, 'বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হলো আমরা যে পথে এগোচ্ছি, তা বজায় রাখা—অর্থাৎ ব্যাটারি, সৌর ও বায়ু প্রকল্প নির্মাণ।'

তিনি আরও বলেন, 'নিউক্লিয়ার জ্বালানির ধারণাটি জীবাশ্ম জ্বালানি খাত ও তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের তুষ্ট করতে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি আগামী দুই দশকেও এক কণাও বিদ্যুৎ দেবে না।'

অস্ট্রেলিয়ান কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের পারমাণবিক বিশ্লেষক ডেভ সুইনি বলেন, এখন দিক পরিবর্তন করলে অর্থনীতিতে ‘অস্থিরতা ও ধস’ দেখা দেবে।

তিনি বলেন, 'যখন অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছি, তখন কেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সরে আসবো? এটি ১৯৫০-এর দশকের নীতি, ১৯৫০-এর দশকের প্রযুক্তি মাথায় রেখে তোলা হয়েছে।'

‘পুরোনো নিষেধাজ্ঞায় আটকে থাকা’

ডাটনের রক্ষণশীল জোট ক্ষমতায় এলে স্থানীয় সরকার, সম্প্রদায় ও বিভিন্ন অংশীজনদের কাছ থেকে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধিতা আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুইনি।

তিনি বলেন, 'এটি জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিষ্কার জ্বালানি নিয়ে অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। আমরা আবার ফিরে যাবো সেই অচলাবস্থার জলবায়ু যুদ্ধের দিকে।'

তবে পারমাণবিক জ্বালানির পক্ষে থাকা পক্ষগুলোর মতে, এ ইস্যুতে এখন আলোচনার সময় এসেছে।

‘নিউক্লিয়ার ফর অস্ট্রেলিয়া’ লবি গ্রুপের সদস্য ও নিউক্লিয়ার আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কির্সটি ব্রেবন বলেন, 'আমাদের এই কয়েক দশকের পুরোনো নিষেধাজ্ঞা আধুনিক রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তি ও অস্ট্রেলীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতার সঙ্গে আর মানানসই নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'যখন অন্য দেশগুলো পারমাণবিক জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন অস্ট্রেলিয়া আটকে আছে পুরোনো বিধিনিষেধে, যা উদ্ভাবন, কর্মসংস্থান ও পরিচ্ছন্ন ভবিষ্যতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'