শিরোনাম
ঢাকা, ২ মে, ২০২৫ (বাসস): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের খবর শুনে যে স্বস্তির ঢেউ বুকের ভেতর বয়ে গিয়েছিল, শতবর্ষী ডোরোথিয়া ব্যারন আজও তা স্পষ্ট মনে করতে পারেন।
‘ধন্যবাদ, অবশেষে সব শেষ হলো’—ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এই সাবেক সদস্য তখন এমনটাই ভেবেছিলেন বলে স্মরণ করেন।
৮০ বছর পেরিয়ে এসেও উজ্জ্বল চেতনার অধিকারী ১০০ বছর বয়সী ব্যারন—বর্তমানে যোগব্যায়ামের প্রশিক্ষক। কিছুদিন নিজের শততম জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন বিখ্যাত স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমানে চড়ে আকাশভ্রমণ করে। তিনি এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জীবিত খুব অল্পসংখ্যক যোদ্ধাদের একজন, যাদের মনে সেই দিনের প্রত্যক্ষ স্মৃতি আজও সজীব ও সতেজ।
যুক্তরাজ্যে এখন ঠিক কতজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা বেঁচে আছেন, তা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক হাজার যোদ্ধা রয়েছেন। তবে আগামী ৮ মে ইউরোপে বিজয় দিবসের ৮০তম বার্ষিকী হতে যাচ্ছে এমন একটি সময়, যা সম্ভবত শেষ কজন জীবিত যোদ্ধাকে নিয়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বড়সড় সরকারি উদ্যাপন হতে পারে।
এই উপলক্ষে সোমবার থেকে চার দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যুক্তরাজ্য, যাতে থাকবে সামরিক কুচকাওয়াজ, বিমান প্রদর্শনী ও রাস্তায় গণ-উদ্যাপন।
এর আগে এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যারন ফিরে তাকিয়েছেন সেই অতুলনীয় মুহূর্তের দিকে—যখন তার কৈশোরকে গ্রাস করা যুদ্ধ শেষ হওয়ার খবর তিনি পেয়েছিলেন।
'সেই খবরটা ছিল যেন এক কাঙ্ক্ষিত মুক্তির বার্তা, এক বিশাল ভার যেন নেমে গেল কাঁধ থেকে, হৃদয় থেকে,' বলছিলেন তিনি। তবে সেই সময়টি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য এক আকস্মিক মোড় নিয়েছিল।
'আমাদের বলা হলো, ‘ইউনিফর্ম রেখে দাও, এ নাও কিছু পোশাকের কুপন, কিছু খাদ্যের কুপন, বাড়ি যাও।’ ব্যস, ওইটুকুই,' বলেন ব্যারন।
তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। তিনি আদৌ কল্পনাই করতে পারেননি, যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাজ্যে জীবন কতটা কঠিন হতে চলেছে।
'সেই সময়টা ছিল ভয়াবহভাবে কঠিন,' বলেন তিনি। 'আমি বলব না যে দুঃখের সময় ছিল, কিন্তু অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। প্রতিদিন ভাবতে হতো—কাল কী বিপদ এসে পড়ে কে জানে।'
‘তোমরা পেছনে টান লাগছে তো?’
লন্ডনের উত্তরে হারলো শহরের কাছে নিজের বাড়ি থেকে বলছিলেন ব্যারন। যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের দিনগুলো এখনও উজ্জ্বল মনে পড়ে তার। ৬০ বছর ধরে তিনি যোগব্যায়াম শেখাচ্ছেন, এখনও প্রতি সোমবার স্থানীয় একটি ক্লাসে প্রশিক্ষণ দেন।
তার নমনীয়তা—বিশেষ করে ‘ডাউনওয়ার্ড ডগ’ ভঙ্গিতে গোড়ালি মাটিতে রেখে এবং পিঠ একেবারে সোজা করে অবস্থান নেওয়া—তার তরুণ শিক্ষার্থীদেরও চমকে দেয়।
'পেছনে টান লাগছে তো?' এক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি। 'যদি শক্ত বুকের কথা ভাবো, এই আসনটা দারুণ কাজে দেয়,'—নিজের ২০ থেকে ৯৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এমন কথাও বলে ফেলেন তিনি নির্দ্বিধায়। ক্লাস শেষে বলেন, 'চমৎকার লাগছে—একেবারে শান্ত, মুক্ত আর প্রশস্ত।'
স্পিটফায়ারে শতবর্ষ উদ্যাপন
তিনি ২০২৪ সালের অক্টোবরে নিজের শততম জন্মদিন উদ্যাপন করেন স্পিটফায়ারে চড়ে, যা ১৯৪০ সালে জার্মান লুফটওয়াফের বিরুদ্ধে ‘ব্যাটল অব ব্রিটেন’-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
'অসাধারণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল,' বলছিলেন মুখভরা হাসি '। আজকের এই প্রাণবন্ত ব্যারনকে দেখে বোঝা যায়, ১৮ বছর বয়সে তার ভেতরে কতটা দৃঢ় সংকল্প ছিল। তিনি ‘উইমেন’স রয়্যাল নেভাল সার্ভিস’ বা ‘রেনস’-এ যোগ দিতে চেয়েছিলেন প্রাণপণে।
'আমরা হিটলারকে আমাদের দেশ দখল করতে দিতে চাইনি,' বলেন তিনি। তবে ব্যারনের ভয় ছিল, তার উচ্চতা হয়তো কম পড়ে যাবে।
আমি ঠকানোর চেষ্টা করেছিলাম—কার্ডবোর্ড কেটে জুতোর ভেতর রেখে লম্বা দেখানোর চেষ্টা, চুল ফুলিয়ে তোলা,'—হাসতে হাসতে বলেন তিনি।
'আমি ছিলাম মাত্র পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি (১৫৭ সেন্টিমিটার)। কিন্তু মনে হয় তারা বুঝেছিলেন, আমি সত্যিই খুব আগ্রহী ছিলাম, তাই হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন—‘আচ্ছা, ওকে সুযোগ দেওয়া যাক।’ ব্যারন তখন সেনাদের হাতে-কলমে শিখিয়েছেন ভিজ্যুয়াল সিগনাল ও মর্স কোড।
ডি-ডে’র আগমুহূর্তে তিনি যুক্ত ছিলেন ‘মালবেরি হারবার’ নামের ভাসমান বন্দর পরীক্ষায়, যেগুলো পরে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্সে সৈন্য নামানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
তবে তখন তিনি জানতেন না এগুলো আসলে কী কাজে লাগবে। পরে বিষয়টি বুঝে গর্বিত হন। 'খুব ভালো লেগেছিল,' বলেন তিনি। ূভাবছিলাম—‘আহা, আমি তো একটা কাজে এসেছি তাহলে!’
এবারের ইউরোপে বিজয় দিবস তিনি পালন করবেন নেদারল্যান্ডসে ‘ডাচ লিবারেশন ডে’ উপলক্ষে। এরপর ৮ মে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে এক স্মরণসভায় অংশ নেবেন, যেখানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরাও থাকবেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তার পরিচয় হয় আরএএফ-এর সদস্য অ্যান্ড্রুর সঙ্গে। তাদের দুই মেয়ে হয়, বর্তমানে ব্যারন একজন প্রপিতামহী।
২০২১ সালে অ্যান্ড্রু মারা যান, কিন্তু এখনও তার কথা খুব হৃদ্যতা নিয়ে স্মরণ করেন ব্যারন।
তাকে সহজে দমিয়ে রাখা যায় না, তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন—বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে, যা আবারও ইউরোপকে এক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে।
'যুদ্ধে কেউ জেতে না,' বলেন ব্যারন।