বাসস
  ০১ মে ২০২৫, ১৯:২১

পর্যটনের চাপ ও প্রকৃতির বৈরী রূপ: হুমকির মুখে আলবেনীয় উপকূল

ঢাকা, ১ মে, ২০২৫ (বাসস) : জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশৃঙ্খল পর্যটন উন্নয়নের দ্বৈত আঘাতে বিপর্যস্ত হচ্ছে আলবেনিয়ার উপকূল। উত্তরের ভেলিপোয়া থেকে দক্ষিণের গোলেম পর্যন্ত অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলজুড়ে পরিবেশের ওপর তৈরি হয়েছে গভীর সংকট।

উত্তরের ভেলিপোয়ায় ঢেউ ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে শতবর্ষী বনভূমি, আর দক্ষিণের গোলেমে হোটেল ও রেস্তোরাঁর অসংলগ্ন নির্মাণে বাড়ছে উপকূল ভাঙন।

'আলবেনিয়ার ২৭৩ কিলোমিটার উপকূলরেখার মধ্যে প্রায় ১৫৪ কিলোমিটারেই ভাঙন লক্ষ্য করা যাচ্ছে,' এএফপিকে বলেন নগর পরিকল্পনাবিদ বেসজানা শেহু।

২০১৮ সালে যেখানে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৫.১ মিলিয়ন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১ মিলিয়নে। কিন্তু নতুন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বিচ বারের অতিরিক্ত গড়ে ওঠা প্রকৃতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, ফেলছে বিরূপ প্রভাব।

এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।

মন্টেনেগ্রো সীমান্তঘেঁষা সংরক্ষিত এলাকা ভেলিপোয়ায় সমুদ্র প্রতি বছর পাঁচ মিটারের বেশি এগিয়ে আসছে। ইতোমধ্যেই ২১০ মিটার ভেতরে প্রবেশ করে উপকূলীয় বনভূমিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। লবণাক্ত পানির আগ্রাসনে টিকে থাকতে না পারায় হুমকির মুখে পড়েছে পুরো এক বাস্তুতন্ত্র।

গত মাসের শেষের দিকে ভয়ংকর ঝড়ে উপড়ে পড়া অসংখ্য পাইনগাছ করুণভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বালুচরে।

'ভেলিপোয়া পার্ক ছোট হয়ে আসছে,' বললেন শকোডরা অঞ্চলের সংরক্ষিত এলাকা সংস্থার প্রধান আগিম দারদা। তিনি জানান, 'মাত্র দশ বছরেই পার্কটি ৩০ হেক্টরের বেশি ভূমি হারিয়েছে।'

একটি দ্বীপের মৃত্যু

নিকটবর্তী বুনা নদীর মোহনায় ফ্রাঞ্জ যোজেফ দ্বীপটির নাম এখনও মানচিত্র ও পর্যটন নির্দেশিকায় রয়েছে। তবে ২০১২ সালেই সেটি সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

১৮৭০ সালে অস্ট্রিয়ান মানচিত্রকাররা সম্রাট ফ্রাঞ্জ যোজেফ প্রথমের নামে দ্বীপটির নাম রাখেন। মাত্র ১৫০ মিটার দূরে উপকূল থেকে অবস্থিত এই ১৯.৫ হেক্টরের দ্বীপটি ছিল উর্বর পলিমাটিতে গঠিত ও বন্য উদ্ভিদে আচ্ছাদিত।

'অসংখ্য সামুদ্রিক পাখির স্বর্গ, আমাদের জন্যও ছিল এক শান্তির আশ্রয়... এখন আর কিছুই নেই,' আক্ষেপ করলেন স্থানীয় এক বীচ বারের মালিক লুলে কোলি।

এই অঞ্চলে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ দ্বীপটির বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করেছে বলে জানান শকোডরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ অধ্যাপক এরভিস ক্রিমি।

কিছুটা দক্ষিণে কুনে এলাকায় বাসিন্দারাও উদ্বিগ্ন। আগের চেয়ে বড় বড় ঝড়ের হানা বেড়েছে। পুরো উপকূল আজ যেন গাছের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।

'গত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভূমির দিকে আগ্রাসী অগ্রসরমানতা পূর্বাভাস ছাড়িয়ে গেছে,' বলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ জাক গজিনি।

কোনো কোনো অঞ্চলে প্রতি বছর ২০ মিটার পর্যন্ত ভেতরে ঢুকে পড়ছে সমুদ্র।

জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন

সত্তরের দশকে নির্মিত সমাজতান্ত্রিক যুগের উপকূলীয় বাংকারগুলো ঢেউয়ের নিচে হারিয়ে গেছে। স্থানীয়দের ছোট ছোট সমুদ্রসৈকতের বারগুলোও টিকে থাকেনি। তারা বালির বস্তা দিয়ে বাধ তৈরির চেষ্টা করলেও সমুদ্রের শক্তির কাছে তা ছিল নিতান্তই ঠুনকো।

'এখানে আগে দুটি বাংকার ছিল। এখন সেগুলো  পানির নিচে তলিয়ে গেছ,' বলেন ভেরা ফাস্লিয়াজ, যিনি সৈকতে ‘পোসেইডন’ নামে একটি ছোট রেস্তোরাঁ চালান।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন বাতাস উত্তপ্ত, হয়ে উঠছে। আর এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রের পানি। 'সমুদ্র আসছে, সবকিছু নিয়ে যাবে... আরও চার-পাঁচ বছরে এখানে কিছুই থাকবে না,' যোগ করেন তিনি।

আলবেনিয়ার কর্তৃপক্ষ বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি দেশের বহু শহরাঞ্চলেও প্লাবনের গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এই দশকের শেষে উপকূলবর্তী এলাকার এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি প্লাবনের প্রভাব ভোগ করবে।

দুরেস শহরের দক্ষিণে গোলেমে হোটেল মালিকেরা প্রশাসনের উদাসীনতায় ক্ষুব্ধ, বিশেষ করে যথাযথ সমাধান ও নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণ ঠেকাতে ব্যর্থতায়।

'সমুদ্র অপেক্ষা করবে না, অথচ কর্তৃপক্ষ এখনও ঘুমিয়ে,' বললেন হোটেল প্রশাসক এডভিন ডুলে।

গত ১৬ বছরে গোলেমের প্রায় ৭০ মিটার সৈকত বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের মতে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হোটেলগুলো উপকূল ভাঙনের গতি বাড়িয়ে সৈকতের অস্তিত্বই হুমকিতে ফেলছে।

'এটা খুবই উদ্বেগজনক ঘটনা, যা সরাসরি আমাদের অর্থনীতি ও পর্যটনকে প্রভাবিত করছে’, বলেন ডুলে।

'আমরা যদি ছাতা, ডেকচেয়ার কিংবা সৈকতে কাঙ্ক্ষিত বিনোদনের সুযোগ দিতে না পারি, তাহলে পর্যটনসেবার মান কমে যাবে — যার পরিণতিতে কমে আসবে পর্যটকসংখ্যা।'