ছবি : বাসস

ঢাকা, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ভাতসহ কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার বেশী খাওয়া ও কম পরিশ্রমে মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হচ্ছে বলে গবেষণা তথ্য বলছে।

আয়োজিত সভায় ফ্যাটি লিভার এবং এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ‘কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দূরে রাখি’ শীর্ষক এ বছরের প্রতিপাদ্য ।

সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছে এবং সেই তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা-চলাফেরা কম করছে, তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বাহিরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘণ্টার উপরে যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সাথে কায়িক পরিশ্রম কম তাদের ঝুঁকি সবচাইতে বেশি।

আজ রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) হেপাটোলজি সোসাইটি, সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতালের উদ্যোগে গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার ডে উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।

গত ১২ জুন বিশ্বব্যাপি ৮ মবারের মতো পালিত হয়েছে গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার ডে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো: শাহিনুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অফ সায়েন্স মেজর জেনারেল অধ্যাপক (ডা.) এ এস এম মতিউর রহমান (অব.) এবং প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বারডেম হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. গোলাম আযম।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা সকলকে সতর্ক করে জানান, ফ্যাটি লিভার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে অতিক্রম করে ইদানীং ফ্যাটি লিভার প্রাধান্য বিস্তার করছে।

আলোচকবৃন্দ খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী খাদ্য তৈরি করতে বাধ্য করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

তারা জানান, বাংলাদেশে প্রতি তিন জনে এক জনের ফ্যাটি লিভার আছে। প্রায় চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক (ডা.) এ এস এম মতিউর রহমান (অব:) বলেন, ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যেমন কাজ করতে হবে একই সাথে কমিউনিটিকেও যুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। অন্যদিকে, ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে শৈশবকালীন থেকেই সবাইকে সচেতন হতে হবে।

মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মাল্টি সেক্টরকে যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
উল্লেখ্য, লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বি জমাজনিত প্রদাহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস।

অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃস্টি হয় তাকেই স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস  বলা হয়। ফ্যাটি লিভারের বিপজ্জনক পরিণতি হচ্ছে ন্যাশ (এনএএসএইচ) নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপজ্জনকভাবে ন্যাশ এর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। লিভারে প্রদাহ সৃস্টি করা ছাড়াও যকৃতে চর্বি জমার আরো বেশ কিছু খারাপ দিক রয়েছে। এই রোগটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব আশংকাজনক হারে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞবৃন্দ বাংলাদেশে ফ্যাটিলিভার রোগ প্রতিরোধে কর্মপন্থা নির্ধারণে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেন।

সে সুপারিশ তুলে ধরেন সেগুলো হলো—দেশের প্রতিটি স্কুল এবং প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে এবং অন্যান্য শারীরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। মেইন রোডের পাশে বাইসাইকেল চালানো এবং হাঁটার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য উপকারী হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অ›তত পাঁচদিন এবং প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট করে হাঁটতে হবে। দড়ি লাফ এবং সাইকেল চালানো শরীরচর্চার জন্য ভালো। দুধ, ফল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং (ভাজা খাবার) ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালরি গ্রহণ কমাতে হবে। শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গণসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণযুক্ত জাংকফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের পুষ্টিমান সঠিক রাখার জন্য (উদাহরণ স্বরূপ, ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণ পরিহার) খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের অধীনে আনতে হবে। সফট ড্রিংক্সের পরিবর্তে ফ্রেশ ফলের জুস এবং পানি পানকে উৎসাহিত করতে হবে। ছোট-বড় সবার জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, স্কুল এবং কর্মস্থলে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে পুষ্টিমান এবং শক্তিমান (ক্যালরি) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সকল চিকিৎসককে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ন্যাশের ঝুঁকিতে না পড়ে। ব্যবহার ও প্রয়োগ কমানোর জন্য (ঋঅঞ ঞধী) ‘চর্বি বা চিনি কর’ ধার্য করার চিন্তা করা যেতে পারে।

আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন, বিএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ডা. মো: সাইফুল ইসলাম এলিন। ভিডিও বার্তা বক্তব্য রাখেন এশিয়ান প্যাসেফিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. নেকাতি ওরমেসি।

সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, বাংলাদেশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটি সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদ, হেপাটোলজি সোসাইটির প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ট্রান্সপ্লান্ট হেপাটোলজিস্ট ডা. তানভির আহমাদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা আবিদ জাফর, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড এর সিনিয়র কনসালটেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. এস কে বাহার হোসেন প্রমুখ।