শিরোনাম

মো. জহির উদ্দিন বাবর
ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, মূলধন এবং প্রযুক্তির অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হতে পারে।
সম্ভাবনাময় এই খনিজ সম্পদ এখনো অনেকাংশেই অব্যবহৃত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। যে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যত বেশি, সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাও তত বেশি। দেশের শ্রম, মেধা, মূলধন ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে- কয়লা, পিট, কঠিন শিলা, সাধারণ পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর, সিলিকা বালু, সাদামাটি, খনিজ বালু, চুনাপাথর, ধাতব খনিজ ও লোহার আকরিক। প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদ।
প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (জিএসবি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিকভাবে মজুত খনিজ সম্পদের মূল্য ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন (২ লাখ ২৬ হাজার কোটি) ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৪১ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন (২ কোটি ৪১ লাখ ৯৭ হাজার ৩০০ কোটি) টাকা। তবে জিএসবির এ হিসাবে দেশে মজুত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যকে ধরা হয়নি। জিএসবির হিসাবের সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যকে বিবেচনায় নেওয়া হলে দেশে মজুত খনিজ সম্পদের মূল্য আরও কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) উপ-পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বাসসকে বলেন, ‘দেশে আবিষ্কৃত উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা, কঠিন শিলা, সাধারণ পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর, সিলিকা বালু ও সাদামাটি উত্তোলন করা হয়ে থাকে। নদী ও উপকূলীয় এলাকা কক্সবাজার, যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদে খনিজ বালি আছে। বড় নদীগুলোতে আছে মূল্যবান খনিজ বালি। এটি উত্তোলনে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। তবে সাদামাটি স্থানীয়ভাবে কিছুটা উত্তোলন হচ্ছে। সঙ্গে কিছু কাচবালিও উত্তোলন হচ্ছে।’
জিএসবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে আবিষ্কৃত খনিজ সম্পদের যে আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা হয়েছে, তা মূলত মজুত থেকে পাওয়া ধারণাগত একটি সংখ্যা। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা সম্ভব হলে খনিজ সম্পদের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি এ সম্পদের যথাযথ আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বাজারমূল্য অনুযায়ী সম্পদের প্রকৃত আর্থিক মূল্যমান নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে জিএসবি উপ-পরিচালক মো. আলী আকবর বাসসকে বলেন, দেশের অধিকাংশ খনিজ সম্পদের আবিষ্কারক ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর বা জিএসবি। খনিজ সম্পদের আরও অনুসন্ধান ও গবেষণা বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
জিএসবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে আবিষ্কৃত খনিজ সম্পদের মধ্যে কয়লা রয়েছে ৭ হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন। জিএসবি আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্র সমূহের মধ্যে শুধু বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। উত্তোলিত কয়লা দিয়ে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। দিঘিপাড়া ও খালাশপীর কয়লা ক্ষেত্রের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে।
এছাড়া চুনাপাথর রয়েছে ২ হাজার ৫২৭ কোটি টন। টন প্রতি ৩০ ডলার হিসেবে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার ৮১০ কোটি ডলার। কঠিন শিলা আছে ২০ কোটি ১০ লাখ টন, যার আর্থিক মূল্যমান ৫৪২ কোটি ডলার। ২৩ কোটি টন সাদামাটির মূল্য ২ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার। কাচবালি আছে ৫১১ কোটি ৭০ লাখ টন, যার মূল্য ৬ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। ২২০ কোটি টন নুড়িপাথরের মূল্যমান ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার এবং সাড়ে ৬২ কোটি টন লৌহের মূল্য ৬ হাজার ৮৮০ কোটি ডলার।
জিএসবি’র হিসাব মতে, দেশে খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ জেলা সমূহের মধ্যে রয়েছে-সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।
দেশে ৫টি কয়লাক্ষেত্রের মধ্যে জিএসবি ১৯৮৫ সালে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া আবিষ্কার করে। এতে কয়লা মজুত আছে ৩৯০ মিলিয়ন টন। দিনাজপুর দিঘীপাড়া কয়লাখনিটি জিএসবি ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করে। এতে ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত আছে। জিএসবি ১৯৮৯ সালে রংপুরের খালাশপীর কয়লা খনি আবিষ্কার করে। যেখানে ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম খনিজ সম্পদ কোম্পানি ‘বিএইচপি মিনারেলস’ ১৯৯৭ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লাখনিটি আবিষ্কার করে। এতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে। এছাড়া ১৯৫৯ সালে জিএসবি আবিষ্কৃত কয়লাখনি জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি রয়েছে। আর সাধারণ পাথর বা বালি মিশ্রিত পাথর কোয়ারি রয়েছে সিলেটে ৮টি, সুনামগঞ্জে ২টি, পঞ্চগড়ে ১৯টি, লালমনিরহাটে ১১টি এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ১০টি। এসব স্থানে মোট ১ হাজার ৯৬৬ হেক্টর আয়তনে পাথর বা বালু মিশ্রিত পাথর রয়েছে। এছাড়া সিলিকা বালু রয়েছে-সিলেটে ৩টি, মৌলভীবাজারে ৫২টি এবং হবিগঞ্জে ২৩টি। এসব স্থানে ৩৩২ হেক্টর আয়তনে সিলিকা বালু রয়েছে।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) উপ-পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অনেক ধরনের খনিজ সম্পদ থাকতে পারে, তবে কি ধরনের খনিজ রয়েছে তার সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও বেশি বেশি স্টাডি প্রয়োজন।
তিনি বলেন, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লা উত্তোলনে অনেক দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়, কিন্তু বাংলাদেশে কয়লা উত্তোলনে আলোচিত কোনো দুর্ঘটনা নেই। তাই আরও বেশি হারে কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। আমাদের দেশে কয়লা উত্তোলন কম।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ বালিও একটি খনিজ সম্পদ, বালি থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় হয়।
চুনাপাথর মজুদের বিষয়ে জিএসবি জানিয়েছে, দেশে সবচেয়ে বেশি চুনাপাথর মজুত রয়েছে উত্তরের জেলা নওগাঁয়। জেলার তাজপুর, বদলগাছি, ভগবানপুরে ২৫ হাজার মিলিয়ন টনের বেশি চুনাপাথর মজুদ রয়েছে। এছাড়া জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদরে ২৭০ মিলিয়ন টন, পাঁচবিবি উপজেলায় ৫ কোটি ৯০ লাখ টন এবং সুনামগঞ্জের বাঘালীবাজারে ১ কোটি ৭০ লাখ টন, টেকেরঘাটে ১ কোটি ২৯ লাখ টন ও লালঘাটে ১ কোটি ২৯ লাখ টন চুনাপাথরের মজুত রয়েছে।
খনিজ সম্পদ হিসেবে মূল্যবান সাদামাটি রয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে সাড়ে ১২ কোটি টন, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ৬ কোটি ৮০ লাখ টন, নেত্রকোনার বিজয়পুরে আড়াই কোটি টন। দেশের ছয় জেলায় বিপুল পরিমাণ নুড়িপাথর মজুদের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব জেলায় নুড়িপাথরের মোট মজুদের পরিমাণ ২২০ কোটি টন। দিনাজপুরের হাকিমপুরে আকরিক লৌহ মজুত রয়েছে ৬৫ কোটি টন। এছাড়া কাচবালির মজুত রয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টনের বেশি।
এসব খনিজ সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস হতে পারে।