বাসস
  ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৮
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:০৫

সুন্দরবনের ইকো রিসোর্ট পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা

ছবি : সংগৃহীত

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান

খুলনা, ১৩ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : সুন্দরবন সংলগ্ন ঢাংমারী খালের তীরবর্তী লোকালয়ের পাশেই গড়ে ওঠা ইকো রিসোর্ট ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা।

পাশাপাশি স্থানীয় জীবন মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এসব রিসোর্টগুলো। এসব রিসোর্টের মালিক, উদ্যোক্তা এবং স্থানীয়দের মতে এই রিসোর্টগুলোর সঠিক পরিচালনা ও মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত পর্যটন নীতি প্রয়োজন।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, সুন্দরবন সংলগ্ন ঢাংমারী খালের তীর ঘেঁষে ১৩টি বন থিমযুক্ত ইকো রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের এখন প্রধান আকর্ষণ। গোলপাতা, কাঠ এবং বাঁশ দিয়ে  তৈরি অনন্য নকশা করা রিসোর্টগুলি দর্শনার্থীদের প্রাকৃতিক প্রশান্তির পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। একসময় ভ্রমণের কষ্ট এবং সুযোগ-সুবিধার অভাবে পর্যটকরা এখানে আসতে চাইতো না। কিন্তু এখন বেসরকারি উদ্যোগে এসব ইকো রিসোর্ট তৈরি হওয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনে ভ্রমণকারী পর্যটকরা এখন আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা উপভোগ করতে পারেন। একইসাথে এসব ইকো রিসোর্ট স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে।

সম্প্রতি সুন্দরবন ভ্রমণ করে আসা পর্যটক এম এ সাদি বাসসকে বলেন, আমি আমার ছেলে মোবাশ্বের আল-নাফিকে সাথে করে কয়েকদিন আগে সুন্দরবন গিয়েছিলাম।

সেখানে ঢাংমারি ইকো রিসোর্টে রাত্রি যাপন করেছি। ঢাংমারি ইকো রিসোর্টে পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানকার সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই উপভোগ্য। রিসোর্ট থেকে নৌকায় করে সুন্দরবনের ভেতরে বেড়ানোর ব্যবস্থাও রয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ হয়েছে। সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, খুলনা শহর থেকে বাইক যোগে মাত্র দেড় ঘণ্টায় ঢাংমারী ইকো রিসোর্টে পৌঁছানো যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ ইমরান হোসেন, বিশ্বজিৎ মন্ডল, সমীর মন্ডল ও সুদীপ্ত গাইন বাসসকে বলেন, আমাদের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের উপরই নির্ভরশীল ছিল। ফলে বৈধ অবৈধভাবে সুন্দরবনের সম্পদ থেকেই আমাদের জীবিকা আহরণ করতে হতো। কিন্তু এখন গ্রামে ইকো রিসোর্ট গড়ে ওঠায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন আর আমাদের সুন্দরবনের সম্পদ ধ্বংস করতে হয় না।

তারা বলেন, এসব রিসোর্ট ঘিরে গ্রামের পরিবেশও পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা ও সার্বিক কর্মকা-ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী গ্রামের ইরাবতী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ও পিয়ালী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামাল খান বাসসকে জানান, তিনি এবং তার স্ত্রী কবি আঁখি সিদ্দিকা সর্ব প্রথম ২০২১ সালে ইরাবতী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের কাজ শুরু করে ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে একই এলাকায় ২০২৩ সালে পিয়ালী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার গড়ে তোলেন। ইরাবতী ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দেখাদেখি পরবর্তীতে অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন। বর্তমানে ঢাংমারি গ্রামেই ১৩ রিসোর্ট চালু রয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরো সাতটি ইকো রিসোর্ট চালু হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এসব ইকো রিসোর্ট সুন্দরবনের বাইরে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে গড়ে উঠেছে।

সুন্দরবন কেন্দ্রিক ইকো রিসোর্ট শিল্পের উদ্যোক্তা কামাল খান বাসসকে বলেন, ইকো রিসোর্টে অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় বিনিয়োগ কম। এখানে পরিবেশের ক্ষতিও কম।

এসব মাথায় রেখেই সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে ইকো রিসোর্টের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এখানে একদিকে যেমন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা অবস্থান করে খুব কাছ থেকেই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন, অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন। তিনি বলেন, পর্যটকদের খাবারের জন্য গ্রাম থেকেই বাজার করা হয়। সুন্দরবনে যাতায়াতের জন্য গ্রামের নৌকা এবং মাঝি, সড়কে যাতায়াতের জন্য যানবাহন গ্রামের লোকেরাই সরবরাহ করে থাকে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রিসোর্টগুলোতে একমাত্র ম্যানেজার ছাড়া অন্য সব স্টাফ গ্রাম থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রিসোর্টে কমপক্ষে ৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ জন পর্যন্ত জনবল রয়েছে। বর্তমানে এই গ্রামের দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া গ্রামের শিশুদের হাতে খঁড়ির জন্য ইকো রিসোর্ট উদ্যোক্তারা ছোট ছোট পাঠশালা গড়ে তুলেছেন। এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন করে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও পরিচালনা করা হচ্ছে।

কামাল খান বলেন, এসবের মূল উদ্দেশ্য পর্যটন শিল্পকে, বিশেষ করে সুন্দরবনকে পর্যটকদের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানসহ তাদের বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করা। এতে গ্রামবাসীর বিকল্প কর্মসংস্থান হওয়ায় সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীলতা কমছে। ফলে সুন্দরবন অনেকাংশেই চাপমুক্ত থাকছে। এভাবেই আমরা সুন্দরবন কেন্দ্রিক একটি 'পর্যটন ভিলেজ' এবং 'হেলদি ভিলেজ' গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছি।

তিনি জানান, সরকারের সব নিয়ম-নীতি মেনেই ইকো রিসোটগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে  অনুমতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ সূত্রিতা রয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডও ইকো রিসোর্টের বিষয়ে অবগত আছে। তিনি  পর্যটক সহায়ক পর্যটন শিল্পের বিকাশে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, পর্যটকদের  নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পর্যটন সহায়ক একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আওতাধীন ঘাগরামারী ফরেস্ট ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাসসকে বলেন, অনুন্নত বন-সংলগ্ন এলাকায় এই রিসোর্টগুলি গড়ে ওঠায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অবৈধ বন উজাড়ও হ্রাস পেয়েছে।

তিনি বলেন, পর্যটন উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি এ ধরনের বেসরকারি উদ্যোগ সুন্দরবন অঞ্চলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। এটি জাতীয় পর্যটন অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করবে।

খুলনার বন সংরক্ষক (সিএফ) ইমরান আহমেদ বাসসকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ম্যানগ্রোভ বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার লক্ষ্যে আমরা সব পর্যটন স্পটে বিভিন্ন অবকাঠামোগত সরঞ্জাম তৈরির জন্য কাজ করছি। ব্যাপক পর্যটন, অসংগৃহীত বর্জ্য এবং নিষ্কাশন চাপ বনের ক্ষতি করতে পারে। এ কারণে আমাদের অগ্রাধিকার হলো কঠোর জোনিং এবং প্রশিক্ষিত ইকো-গাইডসহ পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করা।’

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ। সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্েযর এক বিস্ময়কর পরিসর রয়েছে। এখানে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ২১০ প্রজাতির মাছ, ছয় প্রজাতির ডলফিন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে।

বন বিভাগের রেকর্ড অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সুন্দরবনে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৭৫ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২২-২৩ অর্থবছরে ২ লাখ ১৬ হাজার ১৪৩ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ লাখ ১১ হাজার ৫৭ জন পর্যটক ভ্রমণ করেছেন।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পর্যটন সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে বন বিভাগ আরও চারটি নতুন পর্যটন অঞ্চল যুক্ত করেছে। এগুলো হলো, শরণখোলার আলীবান্ধা, চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক, খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক এবং কৈলাশগঞ্জ। কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট, হারবাড়িয়া, কলাগাছিয়া এবং করমজলসহ নতুন স্পটগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে।