শিরোনাম

।। দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ।।
কুমিল্লা, ৬ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : লালমাই পাহাড়ের বিরল উদ্ভিদ উদ্যানে প্রতিষ্ঠিত হবে দেশের প্রথম ‘ফরেস্ট মিউজিয়াম’। দেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের এই অভয়াশ্রম গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যায় লালমাই পাহাড়ের বিরল এই উদ্ভিদ উদ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গবেষণারও সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কুমিল্লার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা কোটবাড়ির লালমাই পাহাড়ের সবুজ ভাঁজে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের তৃতীয় বিরল এই উদ্ভিদ উদ্যান। এই উদ্যানে বিপন্ন প্রায় ৭৬ প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে দুষ্প্রাপ্য ও বিরল প্রজাতির কয়েকশ বৃক্ষ। তবে যথাযথ প্রচার ও প্রচারণার অভাবে এখনও উদ্যানটি পর্যটকদের কাছে যথাযথ পরিচিতি পায়নি।
কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৭ একর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত লালমাই উদ্ভিদ উদ্যান। ২০১৫ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০২০ সালের শুরুতে উদ্যানটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। একই বছরের ৭ নভেম্বর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই উদ্যানে সংরক্ষিত ৭৬ প্রজাতির উদ্ভিদের প্রায় ৯০ শতাংশই বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতির। ঢাকার মিরপুর ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পর এটি দেশের তৃতীয় বিরল উদ্ভিদ উদ্যান। বিপন্ন ও দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ সংরক্ষণ, গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত উদ্যানটি উদ্বোধনের চার বছর পেরিয়ে গেলেও দর্শনার্থীর সংখ্যা এখনো সীমিত।
কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জি এম মোহাম্মদ কবির বাসসকে বলেন, বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি, প্রাকৃতিক বিনোদন নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই উদ্যানটি গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি বলেন, লালমাই পাহাড়ের বিরল এই উদ্ভিদ উদ্যানে ‘ফরেস্ট মিউজিয়াম’ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি হবে দেশের প্রথম ‘ফরেস্ট মিউজিয়াম’। এই উদ্যানে সংরক্ষিত ৯০ শতাংশ উদ্ভিদই বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায়। দেশের জাতীয় সম্পদ হিসেবে এটি উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মোহাম্মদ কবির বলেন, এই উদ্যানটিকে জাতীয় মানের উদ্ভিদ উদ্যান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। তবে সেটি অনুমোদন হয়নি। আমরা পুনরায় এই মাস্টার প্ল্যান মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, উদ্যানে ইট বিছানো আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়ে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। যাদের বেশির ভাগই দেশের গ্রামাঞ্চলে এখন আর দেখা যায় না। প্রতিটি গাছের সাথে প্রদর্শিত রয়েছে নাম, বৈজ্ঞানিক পরিচয়, গোত্র ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখসহ পরিচিতি ফলক।
কুমিল্লা বন বিভাগের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী বাসসকে জানান, লালমাই পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত এই উদ্ভিদ উদ্যানটি দেশের তৃতীয় বিরল উদ্ভিদ উদ্যান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এখানে বিলুপ্তপ্রায় ৭৬ প্রজাতির বৃক্ষ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণভাবে দেখা যায় এমন বহু প্রজাতির বৃক্ষ, লতা, বনৌষধি এবং ফুলগাছও লালন পালন করা হচ্ছে। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, গবেষণা, শিক্ষা এবং পর্যটন এই চার উদ্দেশ্য সামনে রেখে উদ্যানটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
উদ্যানের উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে রয়েছে, রাধাচূড়া, নাগেশ্বর, আগার, নাগলিঙ্গম, কাঞ্চন, অশ্বত্থ, চন্দন, রক্তচন্দন, চালমুগরা, লোহাকাঠ, চাপালিশ, ধূপ, অর্জুন, মহুয়া, তেলশুর, বহেরা, হরীতকী, হিজল, কনক, তমাল, অশোক, পিতরাজ, কুম্ভি, সোনালু, পারুল, জারুল, চম্পা, টগর, লটকন, করমচা, বন পেয়ারা, সিভিট, বাঁশপাতা, বট, কৃষ্ণচূড়াসহ শত শত উদ্ভিদ প্রজাতি।
এ ছাড়াও আছে, ক্যাকটাস হাউস, অর্কিড হাউস, ঔষধি গাছের কর্নার, বিরল উদ্ভিদের বিশেষ বাগান, জলাশয় ও তৃণভূমি, যা পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দর্শনার্থীদের জন্য নির্মিত হয়েছে বসার বেঞ্চ, ছাতা আকৃতির বিশ্রামাগার, পৃথক শৌচাগারসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো।
লালমাই পাহাড়ের উঁচুুনিচু ভূপ্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত উদ্যানটিতে প্রবেশ করলেই দর্শনার্থীদের মন ভরে ওঠে সবুজ প্রকৃতির নান্দনিকতায়। বৃক্ষরাজির ফাঁকে অবিরাম পাখির কলতান, প্রজাপতির বিচরণ ও সুবাসিত ফুলের সমারোহ ভ্রমণপিপাসুদের মন আনন্দে ভরে তোলে।
দুপুরের রোদে কিংবা বিকেলের মৃদু আলো-হাওয়ায় উদ্যানের পথ ধরে হাঁটলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে দর্শনার্থীরা অপার আনন্দ উপভোগ করেন।
উদ্যানে ঘুরতে আসা কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বাসিন্দা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুস সালাম বাসসকে বলেন, এখানে যেসব গাছ আছে, তা এখন গ্রামে-গঞ্জেও দেখা যায় না। নতুন প্রজন্মকে দেশের প্রাকৃতিক ইতিহাস ও উদ্ভিদ সম্পর্কে জানাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এই উদ্যানের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রচারণা বাড়ানো দরকার।’
উদ্যানের পথে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিসা তাবাসুসম মীম এর সাথে। বাসসের সাথে আলাপকালে মীম বলেন, ‘অনেক ঔষধি ও হারিয়ে যাওয়া উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। শিক্ষা সফর ও বাচ্চাদের প্রকৃতি ও উদ্ভিদ সম্পর্কে শেখানোর একটি আদর্শ স্থান হতে পারে উদ্যানটি।’
লাভ ফর ট্যুরিজম বাংলাদেশ-এর সভাপতি মীর মফিজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হারিয়ে যেতে বসা বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণে এ উদ্যানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকদের জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। ভ্রমণ ও গবেষণা উভয় ক্ষেত্রেই কুমিল্লাকে আরও সমৃদ্ধ করবে এটি।
উদ্যান কর্তৃপক্ষ জানায়, উদ্যানের প্রবেশ টিকিটের মূল্য সর্বসাধারণের জন্য ২০ টাকা। ছাত্র-ছাত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৫ টাকা এবং বিদেশিদের প্রবেশ মূল্য ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।