বাসস
  ২২ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৩৭

ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি ও নওয়াব শাহী মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে

ছবি: বাসস

মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ২২ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): জেলার ধনবাড়িতে  দেশের অন্যতম প্রাচীন প্রায় ২০০ বছরের পুরাতন জমিদার বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে ‘নবাব প্যালেস’ বা ‘নবাব মঞ্জিল’ নামে বেশি পরিচিত।

কালের স্রোতে এখন আর জমিদারি প্রথা ও জমিদার নেই। কিন্তু চুন-সুরকির নবাব প্যালেস ঐশ্বর্যে ও ঐতিহ্যে ঠিকই আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

জমিদার বাড়ির শতবর্ষী পুরোনো দেয়ালগুলো আমাদের ইতিহাস আর কালের সাক্ষী। ক্ষয়ে পড়া চুন-সুরকির আস্তরণগুলোয় লুকিয়ে আছে ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্য। জমিদারের বিলাসী প্রাসাদে কারুকার্যখচিত ভবনের সমারোহ। ভবনের দেওয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপিয়াসী ও ইতিহাস প্রেমীরা জমিদার বাড়ি দেখতে ভিড় করছেন।

সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ১০০ টাকায় টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই চোখে পড়বে নয়নাভিরাম সবুজ-শোভিত বাগান। বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ফলসহ নানা প্রজাতির গাছ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ভিড় করছেন নবাব প্যালেসে। কেউ করছে শর্টফিল্ম এর শুটিং, কেউ করছে টিক টক ভিডিও। আবার অনেককেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসছে বেড়াতে।

জানা যায়, ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। এ জমিদার বাড়ির রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। ধারণা করা হয় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ধনপতি সিংহকে পরাজিত করে সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে আলতাফুন্নাহার কে আলতাফুন্নাহার ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। নওয়াব আলী চৌধুরীর তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সকিনা খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব ওয়াকফনামায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম উল্লেখ করে যান। সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী পরবর্তীকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জমিদার বাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র সন্তান নবাবজাদা সৈয়দা আশিকা আকবরের ছেলে আফিফ উদ্দিন আহমাদ। তিনিই বর্তমানে এটি দেখাশোনা করছেন।

১৭ একর জমির ওপর স্থাপিত অপূর্ব স্থাপত্যকর্মের কারণে ক্রমেই জমিদার বাড়িটি পরিণত হতে থাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে। তাই নবাবের উত্তরাধিকারীরা জমিদার বাড়িতে গড়ে তোলেন পিকনিক স্পট। যা নবাব সৈয়দ হাসান আলী রয়্যাল রিসোর্ট হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা। ১৪ গম্বুজ বিশিষ্ট অপূর্ব মুঘল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ শতাব্দী প্রাচীন নবাব প্যালেস। পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন।

প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরও আছে ফুলের বাগান, বৈঠকখানা, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর। প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘি। দিঘিতে সুন্দর ও মনোরম শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। ইচ্ছে করলে শৌখিন ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে নৌকা ভ্রমণ ও মাছ ধরতে পারেন। আরেকটি আকর্ষণ নবাব মসজিদ। স্থানীয়রা জানান, জমিদার বাড়ির ঠিক পাশেই রয়েছে প্রায় ৭শ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ। মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন এ মসজিদের মোজাইক এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। পুরোনো মসজিদটি দেড়শ বছর আগে সংস্কার করে নবাব পরিবার।

ধনবাড়ীর ৭০০ বছরের পুরনো নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। ২৪ ঘণ্টা এখানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা হয়। গত ৯৮ বছরে এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। মসজিদের ভেতর পালাক্রমে কোরআন তেলাওয়াত করেন আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হাফেজরা।

পীরের নির্দেশনায় কবরের আজাব থেকে মুক্তি পেতে ১৯২৭ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এ মসজিদে সার্বক্ষণিক কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়।১৯২৯ সালে মারা যান এই নবাব বাহাদুর। 

মসজিদের একপাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পরও চলছে কোরআন তেলাওয়াত।

ইতিহাস বলছে, সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামে দুই ভাই ১৬ শতাব্দীতে ঐতিহ্যবাহী এক কক্ষবিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাট আকবরের সময় দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের দায়িত্ব নেন। তারাই নির্মাণ করেন মসজিদটি। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে মসজিদটি সম্প্রসারণ করে এর আধুনিক রূপ দেন। 

সংস্কারের আগে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। সংস্কার করে মসজিদটি বর্গাকৃতির ও তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যের বৈশিষ্টপূর্ণ করা হয়। মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই মসজিদের মেঝে আর দেয়াল কাচের টুকরো দিয়ে নকশাদার মোজাইক করা। মেঝেতে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। ভেতরের সব জায়গা চীনামাটির টুকরো দিয়ে মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ফুলের নকশা। এত বছরে একটু ফাটল পর্যন্ত ধরেনি সেই নকশায়। 

সংস্কারের কারণে প্রাচীনত্ব কিছুটা বিলীন হলেও মসজিদের সৌন্দর্য-শোভা বেড়েছে অনেক।

মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য পূর্ব দিকের বহু খাঁজে চিত্রিত খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ; উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত মসজিদটির চারদিক থেকে চারটি প্রবেশপথ এবং ৯টি জানালা এবং ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট।

মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাবটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। 

কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অষ্টভুজাকার, দুই পাশে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান। ৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের মাথায় স্থাপিত ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।

মসজিদে সংরক্ষিত রয়েছে ১৮টি হাড়িবাতি, যেগুলো শুরুর দিকে নারিকেল তেলের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। মোগল আমলে ব্যবহৃত তিনটি ঝাড়বাতিও রয়েছে।

সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের পাশেই রয়েছে শানবাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। সেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। তার ওয়াকফকৃত সম্পদের আয় দিয়ে মসজিদ, পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসা ও ঈদগাহ পরিচালিত হয়। 

মসজিদের পাশে প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর বিশাল দিঘি। তাতে শানবাঁধানো ঘাট। সেখানে মুসল্লিরা অজু করেন। তা ছাড়া মসজিদের আশপাশে সুপ্রশস্থ ও খোলামেলা অনেক জায়গা রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ করে। এই দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ হয়। তবে শুষ্ক মৌসুমে সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলেও সবচেয়ে বড়  এই দিঘির পানি স্থির থাকে।

মসজিদের খতিব ও ইমাম হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস হুসাইন বাসস কে বলেন, আজান ও নামাজের সময় ছাড়া এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয় না কোরআন তেলাওয়াত। টানা ৯৮ বছর ধরে অবিরত চলছে এই ধারা। 

বর্তমানে মসজিদটিতে ৫ জন হাফেজে কারি নিযুক্ত রয়েছেন। তারা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করেন। এটি বিশ্বের বুকেও একটি বিরল ঘটনা।

ঢাকা থেকে জমিদার বাড়ি বেড়াতে আসা রুবিনা আক্তার বাসস কে জানান, ২০০৬ সালে প্রথম ধনবাড়ী জমিদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন জমিদার বাড়িটি ছিল অত্যন্ত সাজানো গোছানো ও পরিপাটি। 

কিন্তু এবার দ্বিতীয় বার এসে সেটা পেলাম না। অযত্ন অবহেলা ও সময়ের ব্যবধানে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই জমিদার বাড়ীটি আরো সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। যাতে আগামী প্রজন্ম এই জমিদার বাড়ী সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।

গাজীপুর থেকে বেড়াতে আসা কামরুল ইসলাম বাসস কে জানান, আমি এখানে ঘুরতে আসার আগে মহেড়া জমিদার বাড়ি দেখে এসেছি। সেটা অনেক সাজানো গোছানো। ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি পুরো ঘুরে দেখলাম। 

কিন্তু মহেড়া জমিদার বাড়ির মতো সাজানো গোছানো পেলাম না । আমার কাছে মনে হয়েছে, দেয়ালগুলোর প্রাচীন কারুকাজে সংস্কার ও রং দিলে এ জমিদার বাড়ীর ঐতিহ্য গুলো আরো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠবে ।

নরসিংদী থেকে আসা শিক্ষার্থী জুয়েল রানা বাসস কে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে দেখেছি। আজ বাস্তবে বন্ধুদের নিয়ে এসেছি ধানবাড়ী জমিদার বাড়ি দেখতে।  এখানে দেখার মতো অনেক জায়গা রয়েছে । জমিদার বাড়ির ভেতরের পরিবেশ অনেক সুন্দর। এখানে এলে যে কারও মন ভালো হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আমি পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসবো।

ধনবাড়ী জমিদার বাড়ির ম্যানেজার শরীফ উদ্দিন বাসস কে জানান, ধনবাড়ী জমিদার বাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের টাঙ্গাইল সহ সারাদেশের জন্য গর্ব। আমরা চেষ্টা করছি স্থাপনাগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য। জমিদার বাড়ির পাশেই আছে ৬ গম্বুজ বিশিষ্ট জমিদারের থাকার বাসভবন। সুন্দর কারুকাজের মাধ্যমে ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এটি ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় ২শ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়ি দেখতে সপ্তাহের  বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার সবচেয়ে বেশি  দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বাড়ে।

ধনবাড়ি জমিদার বাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী আফিফ উদ্দিন আহমাদ বাসস কে  জানান, জমিদার বাড়ি ও মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোন আর্থিক সহযোগিতা পাই না। 

সরকারের আর্থিক বরাদ্দ পেলে  আমরা বড় ধরনের সংস্কার কাজ করতে পারতাম। ইতিমধ্যে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৭০০ বছরের পুরনো নওয়াব শাহী জামে মসজিদ ও নবাব প্যালেস এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে যতটুকু সম্ভব সংস্কার কাজ করেছি । আগামী শীত মৌসুমে নবাব প্যালেস এর সংস্কারের বাকি কাজও নিজ অর্থায়নে করা হবে বলে জানান তিনি।