শিরোনাম
প্রতিবেদন : বিপুল আশরাফ
চুয়াডাঙ্গা, ২১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন ৪ আগস্ট সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে উত্তাল ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছে মাথায় গুলিবৃদ্ধ হয়ে শহীদ হন মাসুদ রানা মুকুল (৩৫)।
মাসুদ রানা মুকুল চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের স্কুল পাড়ার আব্দুর রায়হান ও জাহানারা খাতুনের ছোট ছেলে। আব্দুর রায়হান ও জাহানারা দম্পতির তিন ছেলে ও দুই ময়ে। মুকুলের বড় ভাই বাবুল আক্তার গ্রামে কৃষি কাজের পাশাপাশি পানের ব্যবসা করেন। ছোট ভাই বকুল বিশ্বাস দুবাই প্রবাসী। বড় বোন মোমেনা খাতুন গৃহিণী। স্বামী ও সংসার নিয়ে মাখালডাঙ্গা গ্রামে শ্বশুরবাড়ি বসবাস করেন। ছোট বোন মাবিনা খাতুনও গৃহিণী। ভোগাইল বগাদী শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
মাসুদ রানা মুকুল ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় সনি সিনেমা হলের পেছনের দিকে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিরলসভাবে সহযোগিতা করেছেন মুকুল।
অন্য দিনের মত ৪ আগস্ট পানির বোতল ও বিস্কুট নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় অবস্থান করছিলেন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে একটি গুলি মুকুলের মাথার পেছন দিক দিয়ে ঢুকে বাম কানের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিউট অব নিউরোসায়েন্সে ভর্তি করা হয়। রাত সোয়া একটার দিকে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মুকুল।
নম্র ও ভদ্র স্বভাবের মাসুদ রানা মুকুলের জন্ম ১৯৯০ সালের ২৩ ডিসেম্বর। কয়রাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে গোকুলখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২০০৬ সালে সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। পরে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন।
২০১২ সালে মুকুল চাকরির সন্ধানে ঢাকায় যান। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছেন তিনি। সর্বশেষ স্মার্ট এ্যালিভেটর কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। শহীদ হওয়ার ছয় মাস আগে দুই বন্ধু মিলে এমএস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন।
১৬ জুন ২০২৫ সোমবার বেলা ১১টার দিকে মুুকুলের গ্রামের বাড়ি কয়রাডাঙ্গায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এক ধরনের নীরবতা ও শূন্যতা বিরাজ করছে। কথা হয় বাবা আব্দুর রায়হান, মা জাহানারা, স্ত্রী সাফা, বড় ভাইয়ের ছেলে রোমান ও প্রতিবেশী জুননুনের সাথে।
শহীদ মুকুলের স্ত্রীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা। তাদের চার বছর বয়সী আরোবী বিনতে মাসুদ নামে একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। স্বামী মুকুল মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে সাফা ঢাকা মিরপুর-১ এলাকায় বসবাস করছিলেন। তবে আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় গত মাসে ঢাকার বাসা ছেড়ে চুয়াডাঙ্গা ফিরে আসেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ৮-৯ মাস ধরে তিনি একটি অনলাইন ব্যবসা করেন। তবে ব্যবসা মন্দা যাওয়ায় সেটা আর ধরে রাখতে পারেনি।
শহীদ মুকুলের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা (৩৫) কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, ৪ আগস্ট রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় মুুকুল বাড়ি থেকে বের হয়। এসময় আমি মুকুলকে বলি, ‘ঢাকার অবস্থা ভালো না, তুমি বাইরে যেও না। মুকুল বলে, ‘আমি আধাঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে চলে আসব।’ এটাই ছিল আমার সাথে মুুকুলের শেষ কথা।
সাফা বলেন, ‘পরে তার বন্ধু আলিমের মাধ্যমে জানতে পারি, সেদিন মুকুল অফিস থেকে ৮-১০টি পানির বোতল ও কিছু বিস্কুট নিয়ে বেলা ১২টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে আন্দোলনে যোগ দিতে যায়। ওখানে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মাঝে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করে। এর আগেও ৫-৬ দিন সে এভাবে শিক্ষার্থীদের পানি সরবরাহ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে, আমি মুকুলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। চিন্তার মাত্রাটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। সন্ধ্যায় খবর আসল মুকুল গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বড় ভাই মোজাম্মেলকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। কেউ যেতে চায় না।’
‘অবশেষে এক রিকশাওয়ালা যেতে রাজি হলো। বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ থাকায় অনেক ঘুরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পৌছলাম। গিয়ে দেখি মুুকুলকে ইমারজেন্সিতে রেখে দিয়েছে। তার আগে ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়েছিল। মাথায় গুলি পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় রাত ৮টার দিকে আইসিইউতে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমার স্বামীকে দেখার জন্য আমাকে আইসিইউতে নিয়ে যায়। তখন সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিল। বিকেলে গুলি লাগার পর মুকুল কোমায় চলে যায়। রাত সোয়া ১টার দিকে হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করার পর হাসপাতাল থেকে একটি ডেত্থ সার্টিফিকেট দেয়। পরে ভোর রাত সাড়ে ৩ টার দিকে লাশ নিয়ে আমরা চুয়াডাঙ্গার উদ্দ্যেশে রওনা দিই। ৫ আগস্ট বাদ জোহর কয়রাডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা সংলগ্ন কবরস্থানে মুকুলকে দাফন করা হয়।
মুকুলের মৃত্যু সাফার সুখের সংসারের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। মেয়ে আরোবী সবসময় বাবা কোথায়, কখন আসবে জানতে চায়। সাফা বিএ পাস। বাবার বাড়ি জেলার দর্শনা পৌর এলাকার আজমপুরে। বাবা আব্দুস সাত্তার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরীজিবী। মা হালিমা খাতুন, গৃহিণী।
সাফা বলেন, ‘মুকুল প্রতিদিন বাইরে গেলেও ফোনে মেয়ে আরোবী ও আমার খোঁজ নিতে। ওই দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফোন করেনি। আমিও শত চেষ্টা করে ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে ঘটনার দিন দুপুরে বড় ভাই বাবুল আক্তারের সাথে ফোনে কথা হয়। মুকুল তখন ভাইকে বলে, ‘দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। আপনি বাইরে যাইয়েন না।’
তখন বড় ভাই বাবুল, মুকুলকে বলে, ‘তুই কি বাইরে? তাহলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যা।’ মুকুল বলে, ‘চলে যাবো ভাই। মাথায় গুলি লাগার ৫ মিনিট আগে বন্ধু আলিমের কাছে বলেছিল, আমি বাসায় চলে যাব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। এরপরই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা জানান, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন তাদের পরিবারকে নগদ সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন থেকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা, আইডিবি থেকে ৫০ হাজার টাকা, বিএনপি ২০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেছে।
সাফা বলেন, ‘কিছুদিন আগে ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে দর্শনায় বাবার বাড়িতে চলে এসেছি। গ্রামে আমার স্বামীর কোন বাড়ি-ঘর নেই। তাই আমার সন্তান নিয়ে থাকার ব্যবস্থা নাই। মুকুল মারা যাওয়ার পর বিভিন্নজনের কাছ থেকে যে অনুদান পেয়েছি, লোন পরিশোধ ও সংসারে খরচ করতে সেটা ফুরিয়ে গেছে। এখনও মুকুলের নামে ব্যাংকে লোন রয়েছে।’
মুকুলের কবরস্থান জঙ্গলে ভরে গেছে উল্লেখ করে সাফা বলেন, ‘স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এখনও মুকুলের নামে কোথাও কোনো ফলক লাগানো হয়নি।’
মুকুলের মা জাহানারা খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে মুকুলের কথা আমি ভুলতে পারি না। সবসময় মনে হয় আমার ছেলে আসছে। আমাকে মা বলে ডাকছে। মারা যাবার দুই দিন আগে মুকুলের সাথে আমার শেষ কথা হয়। সেদিন ছিলো শুক্রবার, মাগরিবের নামাজ পরে বসে আছি, এমন সময় আমার পোতা ছেলে রোমান বলে, ছোট কাকু ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলবে। আমি ফোন নিয়ে কথা বললে মুকুল বলে, মা তুমি খাবার খেয়েছ? আমি বলি, এখন খাবো না, রাতে একবারে খাব। ও বলে, তাহলে এখন বিস্কুট বা কেক খেয়ে নাও।
এরপর মুকুল বলে, তোমার ফোন কী হয়েছে? আমি বলি, আমার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, মুকুল বলে, আমি ফোন কিনে দিচ্ছি, রোববার মোজাম্মেল ভাই চুয়াডাঙ্গা যাবে, ফোন কিনে তার কাছে ফোন দিয়ে দেব। আর সেদিনই মুুকুল আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। আমার মত আর কোনা মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়। সবসময় আমি সেই দোয়া করি।
মুকুলের ভাইপো ঢাকা সিটি কলেঝ থেকে এবার সে এইসএসসি পরীক্ষার্থী রোমান বলে, চাচার বাসায় থেকে লেখাপড়া করতাম। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন হল বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি চাচার বাসায় গিয়ে উঠি। চাচা আমাকে সন্তানের মত ভালোবাসত। অনেক ভালো একজন মানুষ ছিল।
প্রতিবেশী জুননুন বলেন, মাসুদ রানা মিশুক প্রকৃতির ছেলে ছিল। সে যে এতো অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে যাবে ভাবতে পারিনি। আন্দোলনে তার অবদান জাতি কখনো ভুলবে না। তার শিশু কন্যা ও স্ত্রীর ভরণ-পোষনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার আহ্বায়ক আসলাম হোসেন অর্ক বলেন, মাসুদ রানাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সামাজিকভাবে মর্যাদা দিতে হবে। অর্থনৈতিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে খুব শিগগির একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কবরস্থান সংস্কার করার আহবান জানাচ্ছি। তার পরিবার সরকার থেকে এককালীন অর্থ সহায়তা পাবেন বলে জানান তিনি।