শিরোনাম
খুলনা, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ঢাকার রূপনগরের বাইতুস সবুজ মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র শেখ মো. সাকিব রায়হান আওয়ামী লীগ সরকার পতনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জীবন দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
‘বিজয়ের পর আমি ভালো চাকরি নিয়ে বাড়ি ফিরব। আমি তোমাকে সুখী করতে চাই, আব্বা। তোমার আর কাজ করতে হবে না।' ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত অবস্থায় খুলনায় বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে এসব বলেছিলেন সাকিব।
চোখ মুছতে মুছতে সাকিবের বাবা আজিজুর রহমান বৃহস্পতিবার বাসসকে বলেন, ‘যখন শেখ হাসিনা ছাত্রদের রাজাকারের সন্তান বলে আখ্যা দেন, তখনই সাকিব আন্দোলনে যোগ দেয়।’
আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে হত্যার সঙ্গে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান ও অন্যদের বিরুদ্ধেও মামলা করতে চাই। তারা সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
রাজধানীতে আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহীদ হওয়া শেখ মো. সাকিব রায়হান (২২) ফ্রিজিং গাড়িতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেন।
মাদ্রাসা থেকে পড়ালেখা শেষ করে সাকিব ভাগ্য বদলাতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, খুলনায় ভালো চাকরির সুযোগ খুবই কম। তাই ঢাকায় থাকতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কিছু বিফলে গেছে- বলেন আজিজুর রহমান।
‘১৯ জুলাই বিকাল ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি ফোন পাই। জানানো হয়, আপনার ছেলে সাকিব আর নেই। একজন বাবার জন্য তার সন্তানের মৃত্যুর খবরই পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখজনক ও কষ্টদায়ক সংবাদ’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন তিনি।
২০ জুলাই ফজরের নামাজের পর জানাজা শেষে খুলনা নগরীর বসুপাড়া কবরস্থানে সাকিবের দাফন সম্পন্ন হয় বলে জানান তিনি।
শেষ কথা স্মরণ করে আজিজুর বলেন, তার ছেলে একজন মাদরাসাছাত্র ছিলেন এবং শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত জাতীয় অর্থশুমারিতে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তবে তিনি একটি নতুন চাকরি পেয়েছিলেন, ১ আগস্ট থেকে যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু তিনি আর সেই চাকরিতে যোগ দিতে পারেননি। তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি, পরিবারের ভাগ্যও বদলায়নি।
১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন সাকিব। একপর্যায়ে পুলিশ সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, সাকিব রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে আজিজ বলেন, গুলি ডান বুকে লাগার পর তা পেছন দিক দিয়ে মেরুদণ্ড ও কাঁধ ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
‘একটি স্বপ্নময় বুক গুলিতে বিদ্ধ হয়ে থেমে গেল। অধিকাংশ সন্তানই হয়তো ফিরে আসবে মা-বাবার কাছে, কিন্তু সাকিব আর কোনোদিন ফিরবে না’- বলেন তিনি।
সাকিব খুলনা সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নবপল্লী এলাকার বাসিন্দা শেখ আজিজুর রহমানের পুত্র। আজিজ একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানি, যিনি করোনার সময় কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ করে শ্বশুরবাড়ির সামনের ছোট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করতেন।
বাসস-এর প্রতিবেদক সাকিবের বাসায় গিয়ে তার মা-বাবাকে একটি জরাজীর্ণ ঘরের এক কোণে বাস করতে দেখতে পান।
অনেক সময় ভাষা দিয়ে সন্তানের করুণ মৃত্যুর যন্ত্রণা প্রকাশ করা যায় না, সাকিবের বাবা-মাও তা পারেননি। তার মা এতটাই ব্যথিত ছিলেন যে কাঁদতেও পারেননি। তিনি কেবল কল্পনা করছিলেন, কী যন্ত্রণা নিয়ে তার ছেলে প্রাণত্যাগ করেছেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজিজ বলেন, ‘আমরা বাবা-মা ১২ জুলাই ঢাকায় তার কাছে যাই। তাকে অনুরোধ করি আমাদের সঙ্গে খুলনায় ফিরে আসার জন্য। কিন্তু সে রাজি হয়নি। বলেছিল, ১ আগস্ট থেকে তার নতুন চাকরি শুরু হবে।’
চোখে অশ্রু নিয়ে আজিজ বলেন, ‘সাকিব একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল। সে চিরবিদায় নিয়ে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে একটি হাসিমাখা মুখের জ্বলজ্বলে স্মৃতি— যেন বলছে, বাংলাদেশ এখন বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত। আসুন, আমাদের অধিকারের জন্য দাঁড়াই।'
‘ভাগ্য সাকিবকে নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেয়নি, তবে বিশ্বাস করি পরকালে মহান আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন’— বলেন সাকিবের বাবা।
সাকিবের প্রতিবেশী কামাল হোসেন বাসসকে বলেন, সাকিব আজিজুর রহমানের তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। তারা ঢাকার মিরপুর এলাকায় থাকতেন। সাকিবের ভাই সাব্বির রায়হান ঢাকায় একজন ছোট ব্যবসায়ী এবং তার বড় বোনও বিয়ের পর ঢাকায় থাকেন।
কামাল আরও বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি সাকিব ‘রবি আজিয়াটা লিমিটেড’-এ বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। পরে সেই চাকরি ছেড়ে খুলনায় ফিরে আসেন। এরপর সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের পর তিনি আবার ঢাকায় যান পরিবারের ভাগ্য বদলাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।