শিরোনাম
প্রতিবেদন : আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল
চাঁদপুর, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : সৈকত চন্দ্র দে সুমন (৪৩)। থাকতেন রাজধানীর শনির আখড়া বাজারের রুপসী গার্মেন্টস গলিতে ভাড়া বাড়িতে। গেল বছর ২০ জুলাই শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে যান ফার্মেসিতে। একহাতে ছিল মোবাইল এবং অপর হাতে মায়ের প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ। ঠিক ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলের ওপর চালানো একটি গুলি সুমনের বুকের পাঁজরে লাগে এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।
সুমন শনির আখড়ায় থাকলেও তার বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি উত্তর ইউনিয়নের উপাদি গ্রামে দুলাল মাস্টার বাড়ির ছেলে। তার বাবা স্বর্গীয় দুলাল চন্দ্র দে। তিনি পেশায় ছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা স্বর্গীয় শিখা রানী দে।
সুমনরা ৩ ভাই, এক বোন। সুমন ছিলেন সবার বড়। মেঝো সুজন চন্দ্র দে (৩৫)। তিনি ঢাকায় অংলকার তৈরির কারখানায় কাজ করেন। ছোট ভাই চন্দন চন্দ্র দে (৩২)।
তিনি রাজধানীর আনন্দ হাউজিংয়ে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত। বোন মৌসুমী রানী দে (৪০)। তার বিয়ে হয়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায়।
শহীদ সৈকত চন্দ্র দের ছোট ভাই চন্দন চন্দ্র দে বলেন, তিনি এবং তার ভাই সুমন পুলিশের অবসপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আনন্দ হাউজিংয়ে চাকরি করেন। সুমন ২০১৬ সাল থেকে এই কোম্পানিতে হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সুমন জীবনে অনেক কষ্ট করে সর্বশেষ অবস্থানে পৌঁছেন। কারণ আমার বাবা স্কুল শিক্ষক হলেও আয় ছিল খুবই কম। কারণ তিনি প্রতিবন্ধী ছিলেন। যে কারণে আমাদের ভাই-বোনদের বড় করার জন্য বড় ভাই-ই আমাদের দায়িত্ব নেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় টিউশন করে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। সে কারণে গ্রামের সবাই সৈকতকে সুমন মাস্টার হিসেবে চিনেন।
শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমনের জন্ম ১ মে ১৯৮১। ১৯৯৭ সালে নিজ এলাকার বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে মতলব ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০২ সালে একই কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন।
সুমন খুবই মেধাবী ছিলেন। ২০০৩ সালে আকিজ গ্রুপে, ২০০৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে, ২০০৮ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল, ২০১১ সালে ব্র্যাকে এবং ২০১৫ সালে শনির আখড়ায় একটি বিদ্যালয়ে কাজ করার পর সর্বশেষ ২০১৬ সালে আনন্দ হাউজিংয়ে হিসাব রক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
সংসারের আয় বৃদ্ধির জন্য একই সাথে তিনি সন্ধ্যার পরে শনির আখড়ায় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে তিনটি টিউশন করতেন। শুধু তাই নয়, নিজ সন্তানদের গণিত ও ইংরেজি তিনি নিজে পড়াতেন। অন্য বিষয়ের জন্য একজন শিক্ষক ছিল।
শহীদ সুমনের মেঝো ভাই সুজন চন্দ্র দের কাছে তার ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলে শুধু কান্না করতে থাকেন। ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে ঠিক মতো কথা বলতে পারছিলেন না।
তিনি বলেন, জুলাই মাসের ৮ তারিখে তার সাথে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ সুমনের কথা হয়। ভাই তাকে আন্দোলন থেকে দুরে থাকার জন্য সতর্ক করেন। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকায় থাকতাম।
তিনি আমার বড় ভাই হলেও বন্ধুর মত ছিলেন। তিনি আমাদেরকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি। সব সময় সকল বিপদে আপদে এগিয়ে আসতেন। অসুস্থ হলে নিজে নিয়ে ডাক্তার দেখানো এবং সেবা ও করতেন।
সুজন চন্দ্র দে আরও বলেন, আমার মা ঢাকা গেলে ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে ভাই শহীদ হন। ভাইয়ের মৃত্যু শোকে ৭ মাস পর মায়েরও মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যু হয় আরও আগে। আমরা সবাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ি।
আমাদের পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে আমার বড় ভাই শহীদ সৈকত চন্দ্র দের স্ত্রী স্বপ্না রানী দে, ভাতিজা ধ্রুব চন্দ্র দে (১২) ও মাতৃকা রানী দে (৮)কে নিয়ে বাবার বাড়ি রংপুরে চলে যায়।
শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমন স্বপ্না রানীর সাথে প্রেম করে ২০১২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার বাবার নাম সতীশ চন্দ্র গোলদার। পেশায় ছিলেন কৃষক। মা কুসুমী রানী গোলদার ছিলেন গৃহিণী।
তখন তাদের অবস্থান ছিল কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার কংশনগর গ্রামে। তাদের আদি নিবাস রংপুর জেলায়। তবে আমরা কখনো সেখানে যাইনি। তারা এক ভাই এক বোন, শুনেছি ভাই ঢাকায় ছোট কোম্পানির চাকরি করে, বাড়ির সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। বৌদি এখন তার মায়ের আশ্রয়ে আছেন সন্তানদের নিয়ে।
শহীদ সৈকত চন্দ্র সুমনের স্ত্রী স্বপ্না রানী দে বলেন, আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকার কারণে গ্রাম থেকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বাসায় আসেন। মার সুস্থতার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করান। তখন দেশে ছাত্র-আন্দোলন চলছিল।
ঘটনার দিন ২০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শনির আখড়া বাজারের প্রধান সড়কে মায়ের ওষুধ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ঠিক ওই সময় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালায়। তার একটি গুলি এসে পড়ে সুমনের বুকের পাঁজরে। ঘটনাস্থলেই তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় লোকজন তার মরদেহ পাশের গলিতে এনে রাখেন।
তিনি বলেন, তার মৃত্যুর সংবাদ পাই আমার বান্ধবীর ফোন থেকে। কারণ মৃত্যুর আগে সুমনের মোবাইল থেকে তার সাথে আমি কথা বলি। ফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখি। লোকজন বলাবালি করে সুমনের মৃত্যু হয়েছে এবং লোকজনসহ বাসায় নিয়ে যাই।
পরদিন ভোরে তার মরদেহ যাত্রাবাড়ী থানায় নেয়া হয়। সেখানে পুলিশ তার ময়নাতদন্তও করেনি এবং জিডিও নেয়নি। যার কারণে প্রতিবেশীদের সাথে পরমার্শ করে মরদেহ বাড়িতে এনে সৎকার করি এবং ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ সম্পাদন করে বাসায় চলে আসি।
স্বপ্না রানী বলেন, সুমনের মৃত্যুর পর আমাদের ঘরে ছিল মাত্র ২৫০টাকা। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, তার কোম্পানি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় কিছুদিন পর সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়।
ছেলে শনির আখড়া বর্ণমালা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি এবং মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো রকম সন্তানদের পড়ালেও আর এগোতে পারিনি। যে কারণে জানুয়ারি মাসে বাবার বাড়ি চলে যাই। এখন মায়ের সাথে বাবার বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। কারণ মতলবে আমার স্বামীর কোনো সম্পত্তি নেই। তারাই থাকতেন নানা বাড়ির আশ্রয়ে।
তিনি বলেন, সুমনের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং ডিসির পক্ষ এ পর্যন্ত ৭লাখ টাকা পেয়েছেন। এছাড়াও ঢাকায় জামায়াতে ইসলামী থেকে পেয়েছেন ২লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০হাজার টাকা। এসব আর্থিক অনুদানের টাকা থেকে পারিবারিক খরচ এবং সন্তানদের লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে আসছি।
সন্তানদেরও রংপুরে পড়াতে হচ্ছে। আমি নিজে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আমার কোনো কর্মসংস্থান হলে সংসারের হাল ধরে রাখা সম্ভব হবে।
সুমনের একমাত্র ছেলে ধ্রুব চন্দ্র দে বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার বানাবে। তিনি বলতেন, বিকেএসপিতে ভর্তি করাবেন। বোনকে চিকিৎসক বানানোর কথা বলতেন। বাবার মৃত্যুতে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ। কীভাবে কারা বাবাকে মেরেছে আমরা জানি না। তবে সরকারের কাছে তদন্ত করে আমার বাবার মৃত্যুর সঠিক বিচার দাবি করছি।
শহীদ সুমনের গ্রামের পারিবারিক চিকিৎসক, পল্লী চিকিৎসক সুদর্শন পাল বলেন, সুমনের মৃত্যুর সংবাদে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ সে ছাত্রজীবনে এলাকার অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াত। যে কারণে তার পরিচিতি ছিল। আমার জানা মতে তাদের পরিবার খুবই শান্তিপ্রিয় ছিক।