শিরোনাম
প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি
নারায়ণগঞ্জ, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনে সেদিন সারা দেশ আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। যোগ দেয় বিজয় মিছিলে। 'আমার বাবায়ও রক্তে ভেজা সেই আন্দোলনে গেছিল। কিন্তু বিজয় দেখে যাইতে পারে নাই। আমারে শোকের সাগরে ভাসায়ে একা করে চলে গেছে পরপারে।' অশ্রুসিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ সুলাইমানের মা রোকসানা বেগম।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান সুলাইমান।
শহীদ ছেলের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে রোকসানা বেগম বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের ডাচ-বাংলা ব্যাংকে যেদিন আগুন লাগল সেদিন সুলাইমান সেখানেই ছিল, ওর সামনে লাশের পর লাশ পড়ে ছিল।
আমারে কয়, আম্মি, আমি গুলিতে আহত ছেলেগো সুগন্ধা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। আমি কইলাম কি, তুই গুলি খাইলে কে নিবো? আমার বাবায় তো গুলি খাইয়া যাত্রাবাড়ী রাস্তায় পইড়া ছিল, কেউ আমার বাবারে সময়মত মেডিকেলে নেয় নাই। এ কথা বলে অঝোরে কাঁদেন এই মা।
শহীদ সুলাইমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মাদানীনগর এলাকার মিরাজ ব্যাপারী ও রোকসানা বেগমের একমাত্র ছেলে । দুই কন্যা সন্তানের পর সুলাইমান ছিলেন বাবা মায়ের আদরের পুত্র। মিরাজ ব্যাপারী সৌদি প্রবাসী। দুই মেয়ের বিয়ের পর ছেলেকে নিয়েই ছিল রোকসানার সংসার। স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে বড় মাওলানা হবে।
উনিশ বছর বয়সী সুলাইমান মিরপুর দারুর রাশাদ মাদরাসায় পড়তেন। ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, 'বড় আশা কইরা আল্লার কাছে চাইছি, দুই মাইয়ার পর, আল্লাহ তুমি একটা ছেলে দেও। বড় মাওলানা হবে, আমি মারা গেলে আমার কবরের পাড়ে কোরআন তেলওয়াত করব, আমার জানাজা পরাইবো। আমার ভাগ্যে তো এগুলা হইলো না!'
ছেলের সাথে শেষ স্মৃতি স্মরণ করে রোকসানা বলেন, 'সকালে ডিম ভাজি দিয়া খিচুড়ি খাইয়া গেছিল। ওরে যাইতে না করেছিলাম আমরা সবাই, কিন্তু ওয় বলে, আম্মি দেখেন, যাত্রাবাড়ীর ছাত্ররা ফজরের পর সবাই নাইমা গেছে, আমারেও যাইতে দেন। আমি কইলাম, তুই সামনে সৌদি আরব চইলা যাবি এগুলা তো স্কুল কলেজের ছাত্রদের জন্য। ওয় বলে, 'যে পুরুষ, সে কি এসব অত্যাচার দেইখা ঘরে থাকে?'
মরণের আগেও সুলাইমান মানুষকে সাহায্য করেছিল জানিয়ে এই মা বলেন, আমার বাবার অনেক সাহস ছিল, কেমনে যে গেছে! জোহরের আজান যখন দিছে তখন ফোনটা রিসিভ করছে, শুনলাম কাগো যেন সাবধান করে বলতাছে, এই ওদিকে গুলি, ওদিকে গুলি। এই গুলিই আমার বাবার গায়ে লাগছে। আযানের পর আর আমার ফোনটা রিসিভ করে নাই।
ও ফোন ধরছিল, কিন্তু আমার সাথে কোন কথা বলতে পারে নাই তখন।
'ওর সামনে এতো হইচই, সবাই মিছিল করতাছিল, এতো আওয়াজে ওয় আমার কথা কিছু শুনে নাই। আমার ফোন রিসিভ করছে কিন্তু আমার শেষ কথা আমার বাবায় শুনে নাই।
আমারে শেষবারের মতো মা ডাকতে পারে নাই। আমি বলছিলাম 'সুলাইমান সুলাইমান তুই কোথায়? আমি যে ডাকতাছি সেটা ওয় শুনে নাই।'
যোহরের আযানের পর সুলাইমানের সাথে তার পরিবারের আর যোগাযোগ হয়নি। সুলাইমানের দুলাভাই শামীম কবির বলেন, সোলাইমানের সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত আর কোন যোগাযোগ করতে না পেরে আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করি। রাতে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে ওর লাশ পাই। পরদিন জানাজা দিয়ে মাদানীনগর স্থানীয় কবরস্থানে ওরে দাফন করা হয়।
ছেলের মৃত্যুর নয় মাস পেরিয়ে গেলেও ছেলের স্মৃতি আজও তার মাকে তাড়া করে। প্রতিটি সকালে ছেলের অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতা যেন তাকে অজোরে কাঁদায়।
রোকসানা বেগম বলেন, আমার বাবায় দেইখা গেল, আমি গরুর গোস্ত রানছি। আমার বাবার হাড্ডিওয়ালা গরুর গোস্ত পছন্দ আছিলো। আমার বাবায় আইয়া খাইবো, আমার বাবায় তো আর আসলো না। আমি কেমনে বাঁইচা আছি আমি জানি না, চব্বিশ ঘন্টায় আমার বাবার কথা মনে পড়ে।'
'সকালে জিগাতো, কি নাস্তা করব আজকে? ১০ টা মাস গেলো গা, সুলাইমান আর জিগায় না, কি নাস্তা করব আম্মি। আমার ছেলের স্মৃতি তো আর ভুলতে পারি না।
ছেলেকে হারিয়ে একাকিত্বে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রোকসানা। সুলাইমানের দুলাভাই শামীম কবির বলেন, আম্মা (শ্বাশুড়ি) সুলাইমানের মৃত্যুর পর একা থাকতে পারে না। ঘরে যেখানে তাকায় সেখানেই ছেলের স্মৃতি। মাঝে মধ্যে মাদারীপুর গ্রামে যায়। দুই মেয়ের কাছে থাকে। একা থাকলেই কান্নাকাটি করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গে শামীম কবির বলেন, আমরা সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছি।
ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে সোলাইমানের মা বলেন, আমার ছেলেরে যারা মারছে তাদের আমি বিচার চাই। আমার মতো হাজারো মায়ের যারা বুক খালি করছে, সেই খুনিদের ফাঁসি চাই।
সরকার প্রকাশিত গেজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের তালিকায় সুলাইমানের নাম ৩৭২ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।