বাসস
  ০৪ জুন ২০২৫, ১১:২৬

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে স্বৈরাচার পতনের বিজয় মিছিলে গিয়ে শহীদ হন সাগর ইসলাম

শহীদ সাগর ইসলাম, ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : আবু নাঈম

পঞ্চগড়, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : সাগর ইসলাম (১৯) ছিলেন পঞ্চগড়ের এক স্বপ্নবাজ তরুণ, যিনি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে রক্তঝরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তবে স্বপ্নের বাংলাদেশ আর দেখা হয়নি না তার। একটি বৈষম্যহীন স্বপ্ন নিয়ে স্বৈরাচার পতনের বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ঝরে যায় এই লড়াকু তরুণের তাজা প্রাণ।

সাগরের জন্ম পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের নায়েক পাড়ায়। বাবা রবিউল ইসলাম ও মা সখিনা আক্তারের ঘরে জন্ম নেওয়া সাগর শৈশবেই হারান পারিবারিক বন্ধন। বয়স যখন মাত্র ১০ মাস, তখনই মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে।

এরপর মা তাকে নিয়ে ফিরে আসেন একই ইউনিয়নের কিত্তনিয়া পাড়ায় দিনমজুর মা-বাবার (নানা-নানির) সংসারে। কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা সখিনা। সেই থেকে সংগ্রামী জীবন শুরু হয় সাগরের।

নানা সপিজ উদ্দিন মারা যান চার বছর আগে। এরপর একমাত্র নানিকে নিয়ে মানুষের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ করতে শুরু করেন সাগর।

অভাব-অনটনের মাঝেও দমে যাননি সাগর। শিক্ষাজীবনেও ছিল তার লড়াই। সব বাধা পেরিয়ে তিনি ২০২২ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।

এরপর রোজগারের তাগিদে পাড়ি জমান ঢাকায়। মামা হাসিবুল ইসলামের সঙ্গে মেরুল বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

ঢাকায় থেকেও দেশের রাজনীতির খোঁজ রাখতেন সাগর। স্বপ্ন দেখতেন পরিবর্তনের, বৈষম্যহীন এক সমাজের। সেই স্বপ্নই তাকে টেনে নেয় স্বৈরাচার পতনের বিজয় মিছিলে। শহীদি মৃত্যুর বিরল সম্মান লাভের সৌভাগ্য হয় তার।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে অংশ নেন তিনি। মিছিলরত অবস্থায়

রাজধানী ঢাকার মেরুল বাড্ডা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন সাগর। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত মুগদা হাসপাতালে নিলে রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

রাত ১১টার দিকে সাগরের নিথর দেহ খুঁজে পান স্বজনেরা। পরদিন ৬ আগস্ট মরদেহ নিয়ে আসা হয় চিরচেনা সেই কিত্তনিয়া পাড়ায়। পরে সবার সিদ্ধান্তে সাগরকে দাফন করা হয় তার বাবার গ্রাম নায়েক পাড়া মসজিদের পাশে।

সম্প্রতি কিত্তনিয়া পাড়ায় সাগরের নানির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি ছোট ঘরটির পাশেই দাঁড়ানো নতুন একটি পাকা ঘর। সম্প্রতি ঘরটি শহীদ সাগরের মা-নানির ঠাঁইয়ের জন্য করে দিয়েছে জেলা পরিষদ। এডিপি খাত থেকে ‘গৃহ নির্মাণ প্রকল্প’-এর আওতায় এই পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘরটি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। ঈদের পর সেই ঘরে উঠবেন সাগরের মা-নানি।

কথা হয় সাগরের নানি হালিমা খাতুনের সঙ্গে। যেন স্মৃতি জড়ানো প্রতিটি মুহূর্ত আজ এই বৃদ্ধার চোখে অশ্রু হয়ে ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'সাগর ছোট থেকেই কষ্ট করে বড় হয়েছে। ওর বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমি আর ওর নানা ওকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি। বছর চারেক আগে ওর নানাও চলে গেছে।'

হালিমা খাতুন বলেন, 'একা হাতে সংসার সামলাতে হয়েছে। সাগর তখন আমার সঙ্গে মানুষের বাড়ি কাজ করতে যেত। কখনো অভিযোগ করতো না। বলত- মায়ের চিকিৎসা করাতে হবে, তোমাকেও আর কষ্ট করতে দেবো না। নানি, আমি বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।'

তিনি বলেন, 'ঈদের সময় সাগর আমাকে কত কিছু এনে দিত, আর কখনোই দিবে না। প্রতিবছর, ঈদ আসবে- মানুষজনের ঘরে আনন্দ হবে; কিন্তু আমার সাগর আর আসবে না। আমার আদরের নাতিটা কি করে এত তাড়াতাড়ি চলে গেলো!'

সাগরের মামা হাসিবুল ইসলাম বলেন, 'সাগর আমার সঙ্গেই থাকতো ঢাকার মেরুল বাড্ডায়। আমরা একসঙ্গে খেতাম, ঘুমাতাম, কথা বলতাম। আমি অনেকবার ওকে বলেছি, তুই এসব থেকে দূরে থাক, কিন্তু শুনেনি। ৫ আগস্ট সকালে আমাকে বলেই বের হলো, আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু না, ওর তখন শুধু একটা জেদ। বিকেলে খবর এল গুলি লেগেছে।'

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, শহীদ সাগর ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে আমাদের কাছে ঋণ রেখে গেছেন। শহীদ পরিবারগুলোর পাশে আমরা আছি, থাকবো।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, শহীদ সাগর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছেন। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। প্রশাসন সবসময় তার পরিবারের পাশে রয়েছে।

জানা গেছে, সাগর শহীদ হওয়ার পর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পরিবারটি ৫ লাখ টাকা পেয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়েছে এক লাখ টাকা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ পঞ্চগড়ে শীতবস্ত্র বিতরণে এসে দিয়েছেন আরও ২ লাখ টাকা।