বাসস
  ৩১ মে ২০২৫, ১০:২৫

নিজ জমিতে বাড়ি করা হলো না শহীদ পোশাক শ্রমিক লেবু শেখের

শহীদ মো. লেবু শেখ, ছবি : বাসস

বরুন কুমার দাশ, সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে

ঢাকা, ৩১ মে, ২০২৫ (বাসস) : নিজের কষ্টার্জিত টাকায় একদিন একটি ঘর তৈরি করার স্বপ্ন দেখতেন মো. লেবু শেখ। সে উদ্দেশ্যে বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে গ্রামের বাড়ির পাশে একটি নিচু জমি কিনেছিলেন। পরে সেই জমি ভরাট করা হয় ৪০০ গাড়ি মাটি ফেলে। কিন্তু আর বাড়ি গড়া হয়নি তার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ডুমরাই গ্রামে শহীদ লেবুর বাড়িতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার স্ত্রী সেলিনা আক্তারের (২২)।

তিনি বলেন, ‘আমার সারা জীবনটাই দুঃখে ভরা। সুখ আমার জীবনে আর এল না। জন্মের তিন মাসের মাথায় মাকে হারাই। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর আমাকে খালার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খালার কাছেই বড় হই, কিন্তু সেও একসময় মারা যান। তখন সবাই মিলে আমার বিয়ে দেন লেবুর সঙ্গে।’

সেলিনা জানান, সন্তান না থাকলেও লেবুর সঙ্গে কয়েক বছর ভালোভাবেই কেটেছে তাদের সংসার। কিন্তু সেই সুখের অবসান ঘটে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।

তিনি বলেন, ‘লেবু নিজে জমি কিনে একটি ঘর করার স্বপ্ন দেখত। বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে গ্রামের ভেতরে জমিও কিনেছিল। পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের শুরুতেই ঘরের কাজ শুরু করবে। কিন্তু তা আর হলো না।’

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দেন লেবু। সাভারের আশুলিয়া থানা এলাকায় পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা পরদিন ভোরে নিজ গ্রাম ডুমরাইয়ের কবরস্থানে তাকে দাফন করেন।

শহীদ লেবু শেখ ১৯৮৪ সালের ২৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জোরতুল্লা শেখ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। মা নাজমা বেগম সবুরা (৬৯)। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লেবু ছিলেন দ্বিতীয়। বোনদের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই, দুই ভাই কৃষিকাজ করেন। স্ত্রী সেলিনা বর্তমানে জামালপুরে বাবার বাড়িতে থাকেন।

লেবুর বড় ভাইয়ের ছেলে হাছান বলেন, ‘আমার চাচার কোনো সন্তান ছিল না, আমাকে সন্তান হিসেবে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আমি তাকে 'আব্বু' আর চাচিকে 'আম্মু: বলে ডাকতাম।’

হাছান জানান, ‘ঘটনার দিন অনেকবার চাচা ফোন করেছিলেন, কিন্তু ঘুমিয়ে থাকায় ধরতে পারিনি। পরে দাদিকে ফোন করে বলেছিলেন—হাছানকে বাইরে বের হতে দিও না, চারদিকে ঝামেলা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই খবর পাই, চাচার পেটে গুলি লেগেছে। আমরা গিয়ে পিকআপ ভাড়া করে তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। ৬ আগস্ট সকাল ৯টায় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।’

স্ত্রী সেলিনা বলেন, ‘লেবু খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আল্লাহর পথে চলতে চাইতেন। কোনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আল্লাহ আমার কপালে সুখ রাখেননি, তাই স্বামীকে অসময়ে নিয়ে গেলেন। এখন একটাই প্রার্থনা, তিনি যেন জান্নাতবাসী হন।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।’

লেবুর বড় ভাই ফজল হোসেন বলেন, ‘ভাই হারানোর কষ্ট বোঝানো যায় না। লেবুর নিজের সন্তান না থাকায় আমার ছেলেকে নিজের মতো করে মানুষ করছিল। এখন আমার ছেলেও, আর ভাইয়ের বউ সেলিনাও সবসময় মন খারাপ করে থাকে। ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আর কোনো পরিবার যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে। আমি ভাই হত্যার বিচার চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেলিনা ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছে, স্বামীকেও হারাল। সরকার যদি ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে সে জীবনটাকে হয়তো কোনওভাবে টেনে নিতে পারত।’

লেবুর মা নাজমা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ওকে কিছুই দিতে পারিনি। মানুষের দোকানে কাজ করত, পড়ালেখা করতে পারেনি। সেই ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলল। আমার বুক খালি করে দিল। আমি বিচার চাই।’

সহায়তা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে সেলিনা জানান, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি। আমি ও আমার শাশুড়ি সেই টাকা ভাগ করে নিয়েছি। এছাড়া বিএনপি, জেলা প্রশাসক ও ইউএনও ঈদের আগে আমাদের ঈদসামগ্রী দিয়েছেন।’

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০ আগস্ট দায়ের করা ওই মামলায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং আরও ৩০০ থেকে ৪০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।