শিরোনাম
প্রতিবেদন : আব্দুল আজিজ
মাগুরা, ২৯ মে, ২০২৫ (বাসস) : মাগুরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ হোসেন (২২)। মৃত্যুর আগের সকালেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ফরহাদ তার বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,' চলেন ভাই, শহীদ হয়ে আসি।' এটি ছিল ভাইয়ের সঙ্গে তার শেষ কথা।
গত ৪ আগস্ট ২০২৪, মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ফরহাদ। তিনি শ্রীপুর উপজেলার রায়নগর গ্রামের বাসিন্দা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফরহাদের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বড় দুই বোন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। তাদের বাবা গোলাম মোস্তফা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
পরিবার ও প্রতিবেশীদের মতে, ফরহাদ ভাইদের মধ্যে ছোট হলেও ছিলেন পরিপক্ব, দায়িত্বশীল ও সাহসী। তিনি সক্রিয়ভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং এটিকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। এ কারণে পরিবার কিংবা কেউই তাকে আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেননি।
ফরহাদের বাবা গোলাম মোস্তফা জানান, ফরহাদ প্রতিদিনই পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলত। আন্দোলনের সময়েও নিয়মিত ফোনে খোঁজ-খবর দিত এবং কী ঘটছে তা জানাত।
তিনি বলেন, ছেলের চিন্তাভাবনা স্পষ্ট ছিল, ভয় পেত না। তার এমন আত্মবিশ্বাস ও সাহস একজন বাবার গর্ব হলেও আজ তা হৃদয়বিদারক স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যুর দিন সকালে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলেছিল, কেউই ভাবেনি এটাই হবে শেষ কথা।
বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বলেন, ৪ আগস্ট সকালে ফরহাদ তাকে আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলেছিলেন এবং শহীদ হওয়ার ইচ্ছার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ভাইয়ের এ কথা শুনে তিনি নীরব থাকলে ফরহাদ তাকে ভীরু বলে তিরস্কার করেছিলেন বলে জানান তিনি।
গোলাম কিবরিয়া জানান, তার মায়ের হার্টের সমস্যা থাকায় সবসময় তার পাশে লোক থাকতে হয়। সেকারণে তিনি নিজে বাসায় ছিলেন। কিন্তু ছোট ভাই ফরহাদকে তিনি আটকাননি। এরপর ফরহাদ তাকে বলেছিলেন, তার জন্য দোয়া করতে যেন আল্লাহ তাকে কবুল করেন।
ফরহাদের বড় বোন রোকেয়া খাতুন মৌসুমী জানান, ফরহাদ তার ছোট ভাই হলেও পরিবারের সবার অভিভাবকের মতো আচরণ করতেন। সাহস, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগের মানসিকতা তাকে সবার থেকে আলাদা করেছিল।
ফরহাদের চাচা মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, ফরহাদ ধর্মচর্চায় ছিলেন অগ্রগামী। সবসময় তার সঙ্গে একটি ছোট কোরআন শরিফ থাকত। তিনি শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই নয়, তাহাজ্জুদ নামাজও পড়তেন। ধীরস্থিরভাবে নামাজ আদায় করতেন, যার মধ্য দিয়ে তার ভক্তিপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পেত।
ঘটনার দিন সকালে রায়নগর থেকে সাতজনের একটি দল ইজিবাইকে করে কয়েক দফা বাধা অতিক্রম করে পারনান্দুয়ালী এলাকায় পৌঁছে। তাদের মধ্যে ফরহাদের স্কুলবন্ধু ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেনও ছিলেন।
ইমতিয়াজ জানান, সকাল ১১টার দিকে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। মহাসড়কে আগুন ও সংঘর্ষ দেখে অনেকে ভয় পেলেও নির্ভীক ফরহাদ মোটেই ভয় পাননি।
দুপুর দুইটার দিকে তারা মিছিলের একেবারে সামনে চলে গেলে হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে ধাওয়া শুরু হয়। তখন এক পর্যায়ে একটি গুলি এসে ফরহাদের মাথায় লাগে। নছিমন যোগে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবার জানায়, ফরহাদের দাফন ময়নাতদন্ত ছাড়াই করা হয়েছে। তারা মামলা করেননি, কারণ তারা ফরহাদের মরদেহ আবার কবর থেকে উঠানো হোক তারা তা চান না।
তবে মাগুরা সদর থানায় মামলা হয়েছে এবং তারা সুবিচার প্রত্যাশা করেন। তাদের বিশ্বাস, ঘটনাটি দিনে-দুপুরে বহু মানুষের চোখের সামনে ঘটেছে—তাদের সাক্ষ্যই ন্যায়বিচারের পথ সুগম করবে।
এ ঘটনায় সদর উপজেলার বীরপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. জামাল হোসেন ২১ আগস্ট সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বাদীর দাবি, ঘটনার সময় ফরহাদ তার সামনেই গুলিবিদ্ধ হন।
মামলায় আসামি হিসেবে মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ও মাগুরা-২ আসনের সাবেক সাংসদ এ্যাডভোকেট বীরেন শিকদারসহ ৬৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।