শিরোনাম
ওমর ফারুক
রাজশাহী, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): ঢোপকল রাজশাহীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৮৮ বছর আগে ১৯৩৭ সালে রাজশাহী শহরে আধুনিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এ ঢোপকলের মাধ্যমে। অথচ এই ঢোপকল কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্তির পথে। সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন ঐতিহ্য। ঢোপকলগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে বিকল। শতাধিক ঢোপকলের মধ্যে এখন ৪/৫টি ঠিকঠাক রয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর বেলদারপাড়া, ফায়ারব্রিগেড মোড়সহ হাতেগোনা কিছু এলাকায় কয়েকটি ঢোপকল থেকে এখনো পানি সরবরাহ করা হয়। তবে ঢোপকলের জন্য পানি সরবরাহের যে ব্যবস্থা চালু ছিল, সেটা এখন আর নেই। ঢোপকলে পানির সংযোগ এখন মহানগরীর উপকণ্ঠে স্থাপিত পানি শোধনাগারের সঙ্গে। কিছু কিছু ঢোপকল একবারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে। ব্যতিক্রমী এ পানিকলগুলো আবার চালুর দাবি রাজশাহীর সচেতন মানুষের।
জানা গেছে, মহারানী হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী শহরবাসীর জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রকল্প মহারানী হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মিত হয়। যার অন্যতম নিদর্শন রাজশাহী শহরে অবস্থিত এই ঢোপকলগুলো।
ঢোপকল তৈরির সময় রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন রায় ডি এন দাশগুপ্ত। সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির খুব কষ্ট ছিল। ফলে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা-আমাশয়সহ নানা রকম পেটের পীড়া। কিছু লোকের মৃত্যুও ঘটেছিল এসব রোগের জন্য।
রায় ডিএন দাশগুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯৩৪-৩৯) থাকাকালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির কল স্থাপন করা হবে।
১৯৩৭ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক দিনে মিনিস্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যয় করা হয় আড়াই লক্ষাধিক টাকা। এই কাজে নগরীর নামকরা ধনী লোকেদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করা হয়। সেই সূত্র ধরেই মহারানী হেমন্ত কুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে এগুলো হেমন্ত কুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে।
পুরো শহরজুড়ে প্রায় শতাধিক এমন ঢোপকল স্থাপন করা হয়। মহারানী হেমন্ত কুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে আয়রন ও ক্ষারতা দূর করা হতো। এরপর পানি সরবরাহ করা হতো ঢোপগুলোতে। প্রথমে পাথর কুচি দিয়ে পানি ফিল্টার করা হতো। এরপর সিমেন্টের তৈরি মোটা পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।
ঢোপকলগুলোর প্রতিটির পানি ধারণ ক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন। প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি ‘রাফিং ফিল্টার’। এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরও পরিশোধিত হয়ে বের হতো এবং গরমের সময় মোটামুটি ঠাণ্ডাও থাকতো। সেই সময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলোতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পাওয়া যেত।
প্রতি দুই মাস পর ঢোপকলগুলো পরিষ্কার করা হতো। প্রতি দুই মাস পর ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে, মান ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য।
ঢোপকলগুলো উচ্চতায় ভ’মি থেকে ১২ ফুট উঁচু, ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো সিমেন্টের ঢালাইয়ে তৈরি। ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো প্লাস্টার করা হতো। নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে। চারিদিকে টিনের রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো।
এদিকে, রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন পাঠানপাড়া এলাকায় ১টি, রানীবাজার মোড়ে ১টি, বেলদারপাড়ায় ১টি, অলোকারমোড়ে ১টি ও নগরের কুমারপাড়ায় ১টি ঢোপকল ঠিকঠাক পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের তথ্যে আরো কয়েকটি ঢোপকল থাকতে পারে। অবশ্য সেগুলোর অবস্থা খুব শোচনীয়। তাই সচেতন মহল ঐতিহ্যবাহী ঢোপকলগুলো রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
রাজশাহী ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তৌহিদুর রহমান বলেন, আমার জানা মতে ঢোপকল নিয়ে কোনো প্রকল্প এই মুহূর্তে নেই।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্ত, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক কে এম সাইফুর রহমান বাসসকে বলেন, আমার জানা মতে ঢোপকলগুলো ভালো অবস্থাতেই রয়েছে। এগুলো ছোট ছোট স্থাপনা হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এনে গেজেট করা কঠিন হবে। বর্তমান প্রশাসন এসব ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আমরা আগামী দিনে ঢোপকল নিয়ে কাজ করব।