বাসস
  ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:২৭

সাবমেরিন ক্যাবলে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হচ্ছে দ্বীপ মনপুরা, আলোকিত হবে লক্ষাধিক মানুষ

সাবমেরিন ক্যাবলে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হচ্ছে দ্বীপ মনপুরা। ছবি: বাসস

\ আল-আমিন শাহরিয়ার \

ভোলা, ১১ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলা সদর ভোলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নদী-সাগর বেষ্টিত শতবছরের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রাচীন দ্বীপ জনপদ মনপুরাবাসী অবশেষে আলোকিত হচ্ছেন। একসময়কার ওলন্দাজ, পর্তূগীজ আর মগদের আবাস্থলখ্যাত মনপুরা দ্বীপটি ছিলো সর্বদাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এক অবহেলিত জনপদের নাম মনপুরা। যখন বিশ্বময় সভ্যতার বিকাশের প্রসার ঘটছে, সে সময়ও দ্বীপের মানুষদের থাকতে হচ্ছে-অন্ধকারময় প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এক ঘুমোট পরিবেশে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরা অবশেষে যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সাথে। বছরের পর বছর বিদ্যুৎ সংকটে ভোগা এ উপকূলের মানুষ বহুকালধরে দিনে-রাতে তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পেত না। এবার সেই অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে আলোকিত হতে যাচ্ছে দ্বীপ জনপদের বসতি মনপুরা।

গতকাল শুক্রবার বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নূর আহমদ এবং অতিরিক্ত সচিব (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) কে. এম. আলী রেজা'র নেতৃত্বে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল মনপুরা সফর করেন।

সফর শেষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফজলে রাব্বির সভাপতিত্বে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় সভা করেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নূর আহমদ এবং অতিরিক্ত সচিব কে. এম. আলী রেজা।

সভায় অতিরিক্ত সচিব নূর আহমদ বলেন, মনপুরাকে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে দুইটি টেকনিক্যাল রুট বিবেচনায় আছে। একটি তজুমুদ্দিন উপজেলা থেকে চরকলাতলী হয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে মনপুরায় সংযোগ স্থাপন, অপরটি চরফ্যাশন থেকে নদীর তলদেশ দিয়ে সরাসরি সংযোগ।

অন্যদিকে অতিরিক্ত সচিব কে.এম. আলী রেজা জানান, সাবমেরিন ক্যাবলের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মনপুরার মানুষ অন্ধকারে না থাকেন।
বক্তারা এসময় মনপুরাকে দ্রুত জাতীয় গ্রিডের আওতায় আনার দাবি জানান। 

এসময় উপস্থিত ছিলেন-মনপুরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান মিলন মাতাব্বর, মনপুরা জামায়াতের আমীর মাওলানা আমীমুল ইহসান জসিম, স্থানীয় মনোয়ারা বেগম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুল আলম শাহীন, প্রেসক্লাব সভাপতি অহিদুর রহমান, সাধারন সম্পাদক সীমান্ত হেলাল'সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

এছাড়া প্রতিনিধি দলে ছিলেন- ওয়েষ্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রবিউশন (ওজোপাডিকো)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ জাকিরুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান, পরিচালক মনিরুজ্জামান, মো.আবদুল আজিজ, উপ-সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী নূর মোহাম্মদ ও সিনিয়র সহকারী সচিব হাসান সাদী।

সরেজমিনে মনপুরায় তথ্যানুসন্ধানকালে বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, মান্ধাতা আমলের ডিজেল চালিত জেনারেটর দিয়ে গুটিকয়েক গ্রাহককে রাতে তিনঘন্টা বিদ্যুৎ দেয়া হতো। যা প্রায় সময়ই বিকল থাকে। 

তথ্য অনুযায়ী, গোটা উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৫ মেগাওয়াট। উপজেলা সদর হাজীরহাট ও আশ-পাশের এলাকার ৯শ' ৬৬ জন গ্রাহকের প্রয়োজন ৪ মেগাওয়াট। অথচ মনপুরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে-মাত্র ৪শ ২০ কিলোওয়াট। যা প্রয়োজনের তুলনায় ১০ ভাগের একভাগেরও কম। এখানে ৩ টি জেনারেটর রয়েছে, এর মধ্যে ১ টি বিকল। বাকি দু’টিও দীর্ঘদিনের পুরোনো, পরিত্যক্ত এবং সার্বক্ষণিক চলার অনুপোযুক্ত। যে কারণে যেটুকু বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তাতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়না।

সেখানকার বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী কে.এম. ফরিদুল ইসলাম বাসস'কে জানান, সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমানে উপজেলা সদরে ৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন সোলার বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী উপজেলা চরফ্যাশন থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে মনপুরাকে জাতীয় গ্রীডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে মনপুরাবাসীর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনপুরা উপজেলার রামনেওয়াজ ও বাংলাবাজারে দু'টি বেসরকারি সোলার প্লান্ট থেকে প্রতিদিন ৫শ' কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে, তবে এর মধ্যে ১ হাজার ১শ' ৯৯ জন গ্রাহককে ইউনিট প্রতি ৩৫ টাকা হারে বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। 

স্থানীয়দের অভিমত, জাতীয় গ্রীডের সঙ্গে মনপুরা সংযুক্ত হলে ইউনিট প্রতি মূল্য দাঁড়াবে ৬ থেকে ৭ টাকায়। এতে করে যেমনি বিদ্যুৎহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন মনপুরা আলোকিত হবে তেমনি সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে অবহেলিত দ্বীপবাসী।

উল্লেখ্য, মনপুরা উপজেলা বরিশাল বিভাগ এর ভোলা জেলার দক্ষিণে অবস্থিত। এ উপজেলার মোট আয়তন ৩৭৩.১৯ বর্গ কিলোমিটার। এটি ভোলা জেলার একটি দ্বীপ উপজেলা এবং বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। মনপুরা থানা ৪ টি ইউনিয়ন, ২২ টি মৌজা ও ৩৩ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মনপুরা উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৮৯,৮৮৯ জন। তবে, বিভিন্ন সূত্রে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়; যেমন, একটি সূত্র অনুযায়ী উপজেলাটির মোট জনসংখ্যা ৮৯,৭৪৫ জন এবং জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৪০ জন। আরেকটি সূত্র অনুযায়ী, মনপুরা উপজেলার জনসংখ্যা ৭৬,৫৮২ জন ছিল। বর্তমানে এ জনসংখ্যা লক্ষাধিক হয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধরা জানিয়েছেন। 

এখানকার মানুষ মৎস্য ও কৃষি ভিত্তিক পেশার সাথে তাদের জীবন জীবিকা পরিচালনা করে থাকেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বীপ মনপুরা হচ্ছে-সংসদীয় আসন ভোলা-৪। মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনটি জাতীয় সংসদ এ ১১৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত।

প্রাকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়নাভিরাম মনপুরা হচ্ছে ভোলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে প্রায় ৮০ কিঃ মিঃ দূরে সাগরের বুকে জেগে উঠা এক জনবহুল দ্বীপ। মনগাজী নামে এখানকার একজন আধিবাসী বাঘের আক্রমণে নিহত হন। তার নামানুসারে মনপুরা নামকরণ করা হয় বলে প্রচলিত রয়েছে।

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার মোহনায় ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মনপুরা উপজেলায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস রয়েছে। 

ভোলার জেলা প্রশসাক মো. আজাদ জাহান বাসস'কে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বীপ মনপুরাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যকরী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সাগর মোহনার এজনপদ হবে ভ্রমন পিপাসু দেশ-বিদেশী পর্যটকদের অভয়ারণ্য।