বাসস
  ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৬

গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা : নীতিমালার কাগজে অধিকার, বাস্তবে বন্দী শৈশব

ঢাকা, ৩ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকার করে- দেশের প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতি। তখন হয়তো কেউ ভাবেনি, ৩৫ বছর পেরিয়ে এসেও দেশের লাখো শিশু এখনো অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে, বিশেষ করে তারা যারা প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে শ্রম দিয়ে কাটায় শৈশব। যারা গৃহকর্মে নিয়োজিত হয়ে উঠেছে একেকজন ‘অদৃশ্য’ কর্মী, যাদের জন্য নেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, নেই ছুটি, নেই এমনকি সঠিক পারিশ্রমিক বা ভালো ব্যবহার পাওয়ার নিশ্চয়তাও।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্পষ্ট বলা আছে, ১৮ বছরের নিচে সব মানুষই শিশু। বাংলাদেশ সরকারও এই বয়সসীমা মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের লাখ লাখ শিশু এখনো কাজ করছে-নিয়মিত ও অনিয়মিত, আর তাদের বড় একটি অংশ নিয়োজিত গৃহকর্মে। আইএলও ও ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ, যার একটি বিরাট অংশ শিশু, এবং তাদের মধ্যেও বেশিরভাগ মেয়ে শিশু।

এই শিশুরা শহরের চকচকে ভবনের ভেতরকার একেকটি নিঃসঙ্গ ঘরের অধিবাসী। তারা থাকে মানুষের বাড়িতে, কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়। তারা ‘মেয়ে’ হয়ে আসে, ‘বুয়া’ হয়ে বড় হয়। বয়স যখন শিশুদের হাতে বই থাকার কথা, তখন এদের হাতে ঝাঁড়ু, বালতি, ডায়াপার, কাপড়চোপড় ধোয়ার ঝামেলা। এদের ‘ছুটি’ মানে কাউকে না কাউকে খুশি রাখতে পারা, আর ‘বিনোদন’ মানে অন্য বাচ্চাদের খেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখা।

এই শিশুদের কারো জীবন নিছক গল্প নয়-তারা বাস্তব। যেমন, ৯ বছরের মিনারার জীবন। শেরপুর থেকে তার বাবা একদিন ঢাকায় নিয়ে এলেন, এক পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেবে বলে। তাকে বলা হলো, তেমন কিছু করতে হবে না, শুধু একটি ছোট শিশুর সাথেই থাকতে হবে। ‘সাথেই থাকা’ মানে বাস্তবে দাঁড়ায়, সেই শিশুটিকে কোলে রাখা, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, তার কাপড় ধোয়া, তার খেলায় সাথি হওয়া। দিন-রাত সবসময় তাকেই আগলে রাখা। মিনারার দিন শুরু হয় সেই শিশুটির কান্নার শব্দে, আর শেষ হয় ঘুমন্ত মুখের পাশে বসে থাকার মধ্যে দিয়ে।

তার বেতন মাসে তিন হাজার টাকা। যা শুনে তার বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। পরিবার ভেবেছিল, তারা যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে। মিনারার জীবনে যেটুকু শৈশব ছিল, তা সেই দিনই ফুরিয়ে যায়। এখন সে খেলতে জানে না, জানে না নিজের মতো করে হাসতেও। পাঁচ বছরের ছোট্ট ভাইটাকে বাড়িতে রেখে এসেছে, মায়ের কোলে থাকা সেই স্মৃতি এখন কেবল স্বপ্নে ফিরে আসে। এই ছয় মাসে একবার সে অসুস্থ শিশুটিকে সময়মতো ঘুম না পাড়াতে পারায় তাকে চড় খেতে হয়েছে। একবার শিশুটির পেট খারাপ হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়েছে। অথচ সে এখনো ঠিকমতো বোঝে না-এই শহরের মানুষ কী বলে, কী চায়, কোন ভুলে কেনো শাস্তি হয়।

মিনারার মতো শিশুদের সংখ্যাটা কেবল সংখ্যা নয়, এটি একটি সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। তারা স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে, তাদের খেলার মাঠ হয় অন্যের ঘর, তাদের শৈশব হয় অন্যের সন্তানের দেখাশোনার দায়। তারা নিজের জন্য নয়, নিজের পরিবারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়। অথচ সেই পরিবারের কেউ জানে না, মিনারা কোথায় ঘুমায়, কী খায়, কতটা পরিশ্রম করে।

রাষ্ট্রও এই সমস্যা সম্পর্কে উদাসীন নয়। ২০১৫ সালে সরকার ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে, যেখানে বলা হয়েছে-১২ বছরের নিচে কোনো শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। নির্ধারণ করা হয়েছে কাজের সময়সীমা, ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা ও ন্যায্য মজুরির কথা। কিন্তু এই নীতিমালাটি আজও আইনি কাঠামোতে রূপ নেয়নি, যার ফলে বাস্তবজীবনে তার প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে।

এছাড়া, ২০১৩ সালের চিল্ড্রেন অ্যাক্ট এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা থাকলেও তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। গৃহকর্মের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমখাতে শিশুদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন, কারণ এসব নিয়োগের কোনো সরকারি রেকর্ড থাকে না, তদন্ত করা যায় না, অনেক ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না এমনকি নির্যাতিত শিশুটির অবস্থানও। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর তথ্যমতে, গত এক বছরে নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই শিশু। এই তথ্য আমাদেরকে শুধু বাস্তবতা নয়, লজ্জিতও করে।

গৃহকর্মে যুক্ত শিশুরা অনেক সময় শুধুই শারীরিক শ্রম দেয় না, তারা মানসিকভাবেও চাপে থাকে। তাদের ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম-সবকিছু নির্ধারিত হয় অন্যের প্রয়োজন অনুযায়ী। তাদের কোনও শৈশব নেই, নেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার অধিকারও। তারা যেন এক চলমান শ্রমযন্ত্র, যাদের কাজ মানুষের জীবন সহজ করা, অথচ নিজের জীবন হয়ে থাকে ঘোলাটে, অনিরাপদ আর অন্ধকার।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব, যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত নীতিমালাগুলোকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। 

শুধু নীতিমালা থাকলেই হবে না, সেটা আইন হিসেবে কার্যকর করে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। 

নিয়োগদাতাদের সচেতন করা, সমাজে শিশু অধিকার নিয়ে সংলাপ বাড়ানো, এবং সবচেয়ে বড় কথা, দরিদ্র পরিবারগুলোকে এমন সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করা জরুরি, যাতে তারা আর শিশুদের শহরে পাঠিয়ে শৈশব বিক্রি না করে।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ-এই কথাটি যেন স্লোগান হয়ে না থাকে কেবল। শিশুরা যেন কেবল পরিবারের বা সমাজের বোঝা না হয়, তারা যেন হাসতে পারে, খেলতে পারে, পড়তে পারে, এবং ভালোবাসা ও মর্যাদার সঙ্গে বড় হতে পারে-এই চাওয়াটুকু পূরণ করতেই হবে। মিনারা ও তার মতো অসংখ্য শিশুর মুখে যেন একদিন সত্যিকার হাসি ফুটে ওঠে, সেই চেষ্টাটুকু করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সমাজের দায়িত্ব, আমাদের সবার দায়িত্ব।