বাসস
  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০৯

ভোলা উপকূলের জেলেরা ইলিশ পাচার সিন্ডিকেট বিলুপ্ত চান

ছবি: বাসস

॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥

ভোলা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেশের মৎস্য অভয়ারণ্য খ্যাত উপকূলীয় জেলা ভোলার নদ-নদী ও সাগরে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়লেও তাদের মনে শান্তি নেই। তারা বলছেন, যে মূহুর্তে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছিলো সে মূহুর্তে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ মাছ গোপন পথে বিদেশে পাচার শুরু করেছে। 

শক্তিশালী এসব ইলিশ পাচার সিন্ডিকেট বিগত স্বৈরশাসক জমানাতেই গড়ে উঠেছিলো বলে মৎস্য আড়তদাররা জানিয়েছেন। তারা বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে দেশের সর্ববৃহৎ ইলিশ আহরণের জেলা ভোলা থেকেই বছরজুড়ে বিদেশে ইলিশ পাচার হতো। তখন ওই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করতে পারতেননা।

ভোলা সদরের তুলাতুলি মাছঘাটে গেলে কথা হয় সেখানকার জেলে আমিনুল মাঝি, সালেম মাঝি ও মনোয়ার মাঝির সাথে। তারা বলেন, বিগত আ'লীগ সরকারের জমানায় স্থানীয় কাঁচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আ'লীগের যুগ্ম সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নকীবের নেতৃত্বে ইলিশ পাচারের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। 

পুরো জেলায় আহরিত ইলিশের ওপর ছিল তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। তৎকালীন সময়ে নকীবের নেতৃত্বে ভোলায় অন্তত: অর্ধশতাধিক আড়ৎ নিয়ে গড়ে উঠেছিলো ভারত হয়ে বিভিন্ন দেশে ইলিশ পাচারের শক্ত সিন্ডিকেট। 

কিন্তু বিগত ২৪'এর জুলাই বিপ্লবের পর সেই সিন্ডিকেট হোতা জহুরুল ইসলাম নকীব এলাকা ছেড়ে পালালেও তার সিন্ডিকেট কার্যক্রম এখনো থেমে নেই। কালের পরিবর্তনে শুধু জার্সি বদল হয়েছে। ইলিশ পাচার থামেনি। 

জেলা সদরের ইলিশা মাছ ঘাটে গিয়ে কথা হয়, সেখানকার মৎস্য ব্যবসায়ী বাদশা মিয়ার সাথে। তিনি জানান, সম্প্রতি দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানির যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছিলো, সেই আদেশকে পূঁজিকরে অসাধু পাচার সিন্ডিকেট শুধু ভোলা থেকেই তার বিশগুন ইলিশ মাছ ভারত হয়ে অন্য দেশে পাচার করেছে। 

তথ্য অনুযায়ী, ভোলা জেলা ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত, তাই ভোলাকে ইলিশের বাড়ি বলা হয়। মাছ আহরণের সাথে এ জেলার দুই লক্ষাধিক জেলে জড়িত। এখানকার অধিকাংশ মানুষের পেশা নদী কেন্দ্রীক।

বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী জেলা ভোলা। ভোলার পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে তেতুলিয়া নদী অবস্থিত। ভোলার দক্ষিণে চরফ্যাশন উপজেলার জাহানপূরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরাজ মাছ ঘাটটি অবস্থিত। জেলার একমাত্র মৎস্য এ বন্দরটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরে খুব অল্প সময়ে সামরাজ ঘাটে পৌঁছাতে পারে এবং মাছ ঘাটে অবস্থিত বিভিন্ন গদিতে মাছ বিক্রি করেন। সামরাজ ঘাটে রয়েছে অনেক মাছ ক্রয়ের গদি। গদি মালিকেরা জেলেদের লাখ লাখ টাকা নৌকা প্রতি দাদন দিয়ে রেখেছে, যাতে বাধ্য হয়ে জেলেরা তাদের কাছেই মাছ বিক্রি করেন। সামরাজ ঘাটে ইলিশ ছাড়াও সাগরের বিভিন্ন রকমের মাছ বিক্রি হয়। হাজার হাজার লোক এইঘাটে বিভিন্ন কর্ম করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু যে পরিমান ইলিশ ও দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ সেখানে আহরিত হয়, সেগুলোর অধিকাংশই তৃতীয় হাত হয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার হয়ে চলে যায় ভিনদেশে।

এব্যাপারে কথা হয় সামরাজ মৎস্য আড়ৎ মালিক সমিতির সভাপতি আজিজ পাটওয়ারীর সাথে। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এখানকার জেলেদের আহরিত ইলিশ সিন্ডিকেটের হাতেই চলে যেতো। 

আমরা তাদের বাঁধা দেয়ার সাহস পেতামনা। তবে তিনি অবৈধ এসব সিন্ডিকেট বন্ধ চান। 

সেখানকার জেলে রসূল মাঝি, মিজু মিয়া, কামাল মাঝি ও রহমত উল্যাহ মিয়া বলেন, ভরা মৌসুমের এই শেষ সময়ে আমরা নদী ও সাগরে প্রচুর মাছ পাই কিন্তু আমাগো ভাগ্য খুলেনা। মনে শান্তি পাইনা। মাছ পাই, অথচ মাছের স্বাধ নিতে পারিনা। এর কারণ হিসেবে তারা দুষছেন অবৈধ সিন্ডিকেটকে। তাদের অভিযোগ, অতীতে যেভাবে ইলিশ পাচার হতো এখনো সেভাবেই হচ্ছে। 

স্থানীয় শ্রেণি-পেশার মানুষ জানান, বিদেশে আগে যেভাবে ইলিশ পাচার হতো এখনো সে নিয়ম-ই চালু আছে। শুধু নেতা (তাদের ভাষায়) বদলাইছে, হাত বদলাইছে, নীতি বদলায়নি। তবে জেলেরা দীর্ঘদিনের এই অসাধু সিন্ডিকেট বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বর্তমান সরকারের প্রতি। 

তথ্য সূত্রে জানা যায়, ভোলার ইলিশ সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে অতীতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আড়তে চলে যেতো। সেখান থেকে সেই ইলিশ অসাধু সিন্ডিকেট থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাচার করে মোটাদাগের লাভ গুনতো। 

বিগত সরকারের আমলে নাম কাওয়াস্তে ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও তা ছিলো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে বিশেষ অনুমতিতে সীমিত পরিমাণ ইলিশ পাঠানোর অনুমতির আড়ালে দেশের এক তৃতীয়াংশ ইলিশ-ই পাচার করা হতো সু-কৌশলে। তবে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশনায় এবারের কোটায় অনুমতি ছিল ১ হাজার ২০০ টন ইলিশের। কিন্তু তখন দেশের বাজারে প্রতি কেজি ইলিশ ১৮শ' টাকায় বিক্রি হওয়া মাছ মাত্র ১ হাজার ৫২৫ টাকায় রপ্তানি করা হয়েছে। আর তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে লোকসান দিয়েও এইসব অসাধু সিন্ডিকেট ভিন্ন কায়দায় ফায়দা লুটছে।

সম্প্রতি ইলিশ পাচারের দীর্ঘকালের সিন্ডিকেট গোমর ফাঁস হলে নড়েচরে বসে মৎস্য সম্পদ দপ্তর ও সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশনের চেকপোস্টগুলো। তাই ইলিশ সিন্ডিকেটের পাচার রোধে বিভিন্ন সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। 

বেনাপোল ফিশ কোয়ারেন্টাইন বিভাগের কর্মকর্তা আকসাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, বর্তমানে এখানকার সীমান্ত দিয়ে কোনোপ্রকার ইলিশ ভারতে নিতে দেয়া হচ্ছেনা।

এ বিষয়ে কথা হয় ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেনের সাথে। তিনি বাসস'কে বলেন, 
উপকূলীয় জেলা ভোলা হতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইলিশ পাচার রোধে তার দপ্তর তৎপর রয়েছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের টাস্কফোর্স কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।