শিরোনাম
এসকে রাসেল
কিশোরগঞ্জ, ২৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের পনির বাংলার ঐতিহ্যের অংশ। এর ইতিহাস যে কত শত বছরের পুরোনো। অজস্র বছর গড়ালেও গুণ, বর্ণ আর স্বাদে অনন্য এই পনির স্থান পেয়েছে দেশের ঘরে ঘরে।
মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি, যা আন্তর্জাতিক পরিসরেও এনে দিয়েছে নতুন পরিচিতি। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবেও অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে অষ্টগ্রামের পনিরে।
জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের আয়োজনে ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অষ্টগ্রামের ঐতিহাসিক এই দুগ্ধজাত খাবারকে জিআই সনদ প্রদান করা হয়। এর প্রাপ্তিতে অষ্টগ্রামের পনির এখন দেশের মর্যাদাসম্পন্ন ব্র্যান্ড। এর বাজার ও মূল্য উভয়ই বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বলা হয় ‘হাওড়-বাঁওড় মাছে ভরা, কিশোরগঞ্জের পনির সেরা।’ এটি শুধু স্লোগান নয়, এটি এখন স্বীকৃতি। অবশ্য পনিরের এ খ্যাতির পেছনে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। অষ্টগ্রামের পনিরের ইতিহাস গড়ে উঠেছে প্রায় চার শতাব্দী ধরে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘলদের টেবিলে প্রথম এ পনির পরিবেশ করা হয়।
কথিত আছে, মোগল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তি দেলোয়ার খানের পুত্র পনির খান অষ্টগ্রামে গরু-মহিষের বাথান দেখে প্রভাবিত হয়ে নিজ হাতে দুধ দিয়ে তৈরি করেন এই বিশেষ খাবারটি। তার নাম অনুসারে দুগ্ধজাত এ খাদ্যের নামকরণ হয় ‘পনির’। সেখান থেকেই শুরু, ধীরে ধীরে এটি গোটা হাওর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং রপ্তানিযোগ্য ঐতিহ্যে রূপ নেয়।
এ অঞ্চলে দত্তপাড়া বসতিতে দত্ত বংশীয় অভিজাতরা প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পনির তৈরির প্রচলন করেন। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলায়। অষ্টগ্রামের পনির তৈরি হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে, কোনো রাসায়নিক বা কৃত্রিম উপাদান ছাড়াই।
প্রথমে গরু কিংবা মহিষের কাঁচা দুধ সংগ্রহ করে পুরনো ছানার সংস্পর্শে রেখে জমাট বাঁধানো হয়। এরপর সেই ছানাকে ছেঁকে, বাঁশের ফর্মায় ছাঁচে ফেলে লবণ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণযোগ্য পনির তৈরি করা হয়। এক কেজি পনির তৈরিতে লাগে প্রায় ১০ কেজি গরুর দুধ বা ৯ কেজি মহিষের দুধ।
পনির তৈরির কারিগর মো. তোরাব আলী জানান, বাপ-দাদার পেশা হিসেবে তিনি ছোটবেলা থেকেই পনির তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাদের পরিবারে পনির তৈরির ঐতিহ্য প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো।
অবশ্য এতো গৌরবের পেছনে রয়েছে দু:খবোধও। ষাটের দশকে অষ্টগ্রামের পনিরের জাগরণ বছর। এ সময় হাওরবাসীর ঘরে ঘরে তৈরি হতো পনির। কিন্তু সেই জৌলুস বেশি দিন থাকেনি। তবে মানুষ পেশা পরিবর্তন করলেও পনির তৈরির পেশা বিলীন হয়নি। মুঘল আমলে গড়ে তোলা পনির ব্যবসা এখন ধরে রেখেছেন মাত্র গুটি কয়েক পরিবার।
এর পেছনে মূল কারণ এটিকে শিল্পে রূপ দিতে গড়ে ওঠেনি বড় কোনো ব্যবস্থাপনা কাঠামো। এ পেশার মানুষের উদ্দীপনায় দেওয়া হয়নি সহায়তা। অথচ হাওরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় অংশ বেকার হয়ে পড়েন, তখন তারা পনিরে আয় রোজগার খুঁজে নেন। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সরকারি সহায়তা পেলে অষ্টগ্রামের পনির বৃহৎ শিল্পে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পনির তৈরির কারিগর নিশান মিয়া বলেন, আমাদের পনির আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল, এখন জিআই সনদ পাওয়ায় দেশ-বিদেশে রপ্তানির সুযোগ আরও সহজ হবে। দামও বাড়বে, চাহিদাও বাড়বে। সরকার যদি আমাদের আরও সহায়তা করে, তাহলে অষ্টগ্রামের এই শিল্প বিপ্লব আনতে পারে।
আইনজীবী ও কিশোরগঞ্জের সন্তান শেখ মো. রোকন রেজা বলেন, পনির দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত খাতের সম্ভাবনাময় একটি পণ্য। সরকার যদি মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণ দেয়, তাহলে অনেকেই এ শিল্পে আগ্রহী হবে।
উপজেলার পনির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে অষ্টগ্রামে সরকারি তালিকাভুক্ত ১৪জন পনির কারিগর রয়েছেন। তবে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি সহায়তা পেলে শতাধিক পরিবার পনির শিল্পে কাজ করবে।
তারা জানান, বর্ষা মৌসুমে হাওর অঞ্চলে পর্যটক বাড়ে, তাদের অনেকেই পনির কিনে নিয়ে যান। ব্যবসায়ীরাও এখন জিআই লোগো ব্যবহার করে পনিরের ব্র্যান্ডিং বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। জেলার বাণিজ্য সম্প্রসারণ অফিস থেকে গাভী-মহিষ পালনে প্রণোদনার চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, অষ্টগ্রামের এই পনির আজ কেবল গ্রামীণ জীবনের অংশ নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দ্বার, একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাব্য রপ্তানি পণ্য।
পনির প্রস্তুতকারী রিকা আক্তার বলেন, ১০ কেজি দুধে ১ কেজি পনির হয়, বিক্রি করি প্রায় ৯০০-১২০০ টাকা কেজি দরে। যারা একবার খেয়েছেন, সবাই প্রশংসা করেছেন।
অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. দিলশাদ জাহান বলেন, এখানকার পনিরকে কেন্দ্র করে নতুন ব্র্যান্ডিং ও প্রচার শুরু হচ্ছে। জাইকার সহযোগিতায় একটি সেলস সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। যারা পনির তৈরি করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।