বাসস
  ২৪ মে ২০২৫, ২০:০৮

ঘূর্ণিঝড় আইলা’র বর্ষপূর্তি আগামীকাল

ফাইল ছবি

প্রতিবেদক: এস এম জাহিদ হোসেন

খুলনা, ২৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : আগামীকাল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইলা’র খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানার ১৬ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা’র কারণে যারা তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছিলেন, সেই মুখগুলোর কথা প্রতিবছর এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয়।

ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইলা ও এর কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় বাঁধের ৪০টিরও বেশি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। যার মধ্যে শুধু কয়রা উপজেলাতেই ভাঙন ছিল ২৭টি স্থানে। ফলে, কয়রা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন লবণাক্ত পানিতে ডুবে যায়।

লবণাক্ত পানি প্রবেশের সাথে এই অঞ্চলের মানুষকে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করতে হয়েছে।
খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলে সুপার সাইক্লোন আইলা এবং এর কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে মোট ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

খড়ের তৈরি ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, মাছের ঘের, ফসল, গাছপালা, গৃহপালিত পশু এমনকি এলাকার বাসিন্দারাও স্রোতে ভেসে গিয়েছিলো।

উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ বিশেষ করে কয়রা উপজেলার মানুষের হৃদয়ে আইলা’র অভিশপ্ত স্মৃতি রয়ে গেছে।

হারানো প্রিয়জনদের স্মৃতি তাদের পরিবারের সদস্যদের এখনো তাড়া করে বেড়ায়। সেই সময়ে কবরস্থানের জায়গার অভাবের কারণে অনেকেই তাদের স্বজনদের মৃতদেহগুলোকে কাফন পরিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ষোল বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখনো পুরোপুরি এর প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি। প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন।

কয়রা উপজেলায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, কয়রা সদর এবং মহারাজপুর ইউনিয়নের অনেক মানুষ এখনও বাঁধের উপর তৈরি অস্থায়ী কুঁড়ে ঘরে বাস করছে।

গ্রামবাসীরা জানায়, জলোচ্ছ্বাসে তাদের যা কিছু ছিল সব ভেসে গেছে। শাকবাড়িয়া, কপোতাক্ষ এবং কয়রা নদীর ভাঙনে অনেক মানুষের ঘরবাড়ি এবং কৃষিজমি বিলীন হয়ে গেছে। গাছপালাবিহীন কয়রার সেই আগের পরিবেশ এখনও ফিরে আসেনি। ফলস্বরূপ, শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলটি প্রচণ্ড তাপের কবলে পড়ে, যার ফলে স্থানীয়দের জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন আইলা’র ক্ষয়ক্ষতির শিকার। আলাপচারিতায় তিনি বাসস’কে জানান, আইলার পর অনেক জনপ্রতিনিধিই আক্রান্ত এলাকা হিসেবে কয়রা পরিদর্শন করেছিলেন এবং পুনর্বাসনের জন্য অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সবই ছিল তথাকথিত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।

জমি থেকে যাওয়ার কারণে কিছু লোক নদীর দ্বীপ ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। এমনকি যাদের জমি নেই তারাও এতদিন ধরে সেখানে বসবাস করার পর এই জায়গাটির সাথে মানসিকভাবে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন একারণে তারা অন্যত্র যেতে অনিচ্ছুক।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের শেখ সরদার পাড়ার কৃষক আরিফুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষকরা চাষ করে কিছু ফসল ফলাতে পেরেছেন। কিন্ত এখনও এলাকাটি লবণাক্ততা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি।

মেরামত করা হলেও বাঁধগুলো এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি পুরোপুরি শক্তিশালী না করা হয়, তাহলে আবারও এই বাঁধগুলো ভেঙে অঞ্চলটি লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এস এম লুৎফর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। ষোল বছর কেটে গেলেও অনেক মানুষই এখনও অনেকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরতে পারেননি।

আইলা’র ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, তাদের বেঁচে থাকার জন্য একটি টেকসই বাঁধ অপরিহার্য। একটি টেকসই বাঁধ ছাড়া এই অঞ্চলে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

ষোল বছর আগে এই অঞ্চলটি পানীয় জলের উৎস হারিয়ে ফেলে। এখনও স্থানীয়দের সুপেয় পানির অভাব রয়েছে এবং বেশ কিছু জায়গায় নলকূপ থেকে খাবার পানি আনতে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হয় বলে জানিয়েছে তারা।

গভীর নলকূপ স্থাপন এবং পুকুরের বালি ফিল্টার (পিএসএফ) দিয়ে পুকুর সংস্কার করলে পানির এই সংকট দূর হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

কয়রা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বাসস’কে বলেন, ‘কয়রার প্রধান সমস্যা হল নদীভাঙন। যদি এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। অনেক বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ডব্লিউডিবি) এই বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’

বাসস’র সাথে আলাপকালে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তপন কুমার কর্মকার বলেন, আইলার পর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার করা হলেও তহবিলের অভাবে এখনও বেশ কয়েকটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাগুলোও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেছেন, বিভিন্ন প্রকল্প প্যাকেজের আওতায় কয়রার বাঁধের বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে মেরামতের কাজ চলছে। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং মেরামত কাজ পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাবে।

উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, গত এক দশকে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা সমস্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার উপর আইলা’র প্রভাব ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। মানুষ এখনও সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে লড়াই করছে।

কয়রা ইউএনও রুলি বিশ্বাস বাসস’কে বলেন, কয়রার মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য টেকসই বাঁধ অপরিহার্য।

নদী দ্বারা বেষ্টিত কয়রার বাঁধগুলোই এর জীবনরেখা। প্রতি বছর উপজেলার কোথাও না কোথাও অন্তত একটি বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়।

তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় থেকে এই উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করার একমাত্র সমাধান হল একটি টেকসই বাঁধের ব্যবস্থা করা।